স্বাধীন বণিকে রূপান্তর ও স্বাধীনতা যুদ্ধ

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-৩৬

মিজানুর রহমান শেলী: ১৯৬০-৭০ সালের এই দশকে জহুরুল ইসলাম একজন সফল বা স্বাধীন ব্যবসায় উদ্যোক্তা বনে যান। আগের আলোচনায় এ দশকে জহুরুল ইসলামের ব্যবসায় কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। একজন ব্যবসায় উদ্যোক্তাকে সফল বলা যায় কখন বা কী কী বৈশিষ্ট্য অর্জন করলেÑসে বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। আমেরিকার ভ্যান থার্প ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ভ্যান কে. থার্পের মতে, তিনটি গুণ থাকলে একজন ব্যবসায়ীকে স্বাধীন বণিক বলা চলে। প্রথমত, ব্যবসার সব ধরনের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পূর্ণ করার দায় নিজের ওপর নিতে হবে। এখানে বাজার পরিস্থিতি, মধ্যস্বত্বভোগী, নিজের শিক্ষা-দীক্ষা, এমনকি অন্য কোনো বিষয়ের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, ব্যবসার পরিকল্পনা পরিবর্তন করার সক্ষমতা থাকতে হবে। তৃতীয়ত, নিজের সঙ্গে মানানসই ব্যবসায় কৌশল বা পরিকল্পনা নেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে।
ভ্যান থার্পের এই তিনটি শর্ত জহুরুল ইসলামের জীবনে বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে। জহুরুল ইসলাম একজন ঠিকাদার হিসেবে নির্মাণকাজের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে কখনোই পিছপা হননি। নির্মাণসংশ্লিষ্ট কোনো শিক্ষা-দীক্ষা তার ছিল নাÑতবু তিনি এসবের জন্য হীনম্মন্যতায় ভোগেননি।
তবে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ব্রিটিশ শাসনের নাজুক পরিস্থিতির যতটুকু বিরাজ করছিল তা তার কাজে কোনোভাবেই প্রভাবিত করেনি। কেননা এসব উন্নয়নকাজে সরকারের ছিল দৃঢ় পদক্ষেপ। আবার একজন আবাসন ব্যবসা বা জমি কেনাবেচার পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলেও খুব বেশি সংকটাপূর্ণ অবস্থা লক্ষ করা যায় না।
দ্বিতীয় শর্তে ব্যবসায় পরিকল্পনা পরিবর্তনের সক্ষমতা থাকার কথা বলা হয়েছে। আদতে এই জায়গাতে জহুরুল ইসলাম তার সৃজনশীলতাকে আপন ইচ্ছার মতো ব্যবহার করতে পেরেছেন। যেমন তিনি একজন ঠিকাদার হয়ে রেডিমেড বাড়ি বিক্রির ধারণা বাতলে দিতে পেরেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায় কাঠামোতে, যার নাম হয়েছে পরবর্তী সময়ে আবাসন ব্যবসা।
তৃতীয় শর্তে দেখা যাচ্ছে নিজের সঙ্গে মানানসই ব্যবসা বেছে নেওয়ার সক্ষমতা থাকা। জহুরুল ইসলাম তার বিডিসির আওতাধীন দিগি¦দিক যখন নির্মাণকাজ ঠিকাদারি চুক্তিতে চালিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি নিজের লগ্নিতে বাড়ি নির্মাণ করে তা বিক্রির ধারণা উদ্ভাবন করেন। এই ধারণার সঙ্গে তার নিজস্ব কর্মক্ষেত্রের ছিল সরাসরি সম্পর্ক।
ভ্যান কে. থার্পের মতে, কোনো ব্যবসায়ীর এ তিনটি সক্ষমতার যে কোনো দুটি থাকলেই তাকে স্বাধীন বণিক বলা চলে। আমরা দেখতে পাচ্ছি জহুরুল ইসলাম এই তিনটি শর্তের মধ্যে তিনটিতে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ তাকে একজন সফল বা স্বাধীন ব্যবসায় উদ্যোক্তা বলা চলে।
ভ্যানের মতে, মানসিক ও ব্যবহারিক সক্ষমতা বণিককে আগে থেকেই অর্জন করতে হয়। অনেকে স্বাধীন বণিকের আচরণ নিয়ে কাজে নেমে পড়েন। আসলে তারাই সংকটে পড়েন। এমনকি তা সঠিকভাবে সমাধা করতে ব্যর্থ হন। আমরা জহুরুল ইসলামের পেশা জীবনের ধারাবাহিকতা আগের আলোচনায় দেখতে পেয়েছি। তাতে দেখা গেছে, তিনি নির্মাণ ব্যবসায় আসার আগে রাষ্ট্রায়ত্ত নির্মাণ সংস্থা সিঅ্যান্ডবিতে চাকরি করেছেন। তাছাড়া বাবার মাঠ পর্যায়ের ঠিকাদারি নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা ছোটবেলা থেকেই কিছু কিছু আহরণ করেছিলেন। এমনকি বড় বড় কাজের ঠিকাদারি করার অভিজ্ঞতা থেকেই জহুরুল ইসলাম পরবর্তী জীবনে আবাসন ব্যবসায় নিজেকে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকল। এই পরিস্থিতির মধ্যে জহুরুল ইসলাম ১৯৭০ সালে ৫ হাজার গভীর নলকূপ স্থাপনে চুক্তিবদ্ধ হন। এটা ছিল বিদেশি প্রতিযোগীদের মাঝেও একটি ভালো অর্জন। কেননা এ প্রকল্পটি স্বভাবতই বিদেশি ঠিকাদাররাই সম্পন্ন করতেন। কিন্তু জহুরুল ইসলাম তার নিজস্ব যোগ্যতা ও সুনামের কারণে প্রকল্পটি গ্রহণ করতে সক্ষম হন।
এরপর শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ, তারপর ভারত ভাগ। আর পাকিস্তান সৃষ্টি। ইতিহাস এখানেই শেষ হয় না। শেষ হওয়ার নয়। আর্থসামাজিক রাজনৈতিক হালচাল সবকালেই পরিবর্তন বিবর্তন আর অনিবার্য পরিণতির স্বাভাবিক ধারা। অর্থ, সমাজ, সংস্কৃতি এই তিন বিষয় নিয়ে মানুষের পেট, পিঠ ও সম্মান রক্ষার সংগ্রাম। লড়াইয়ে কেউ স্বাধীন নয়। বণিক, মজুর, কৃষক, চাকরিজীবী কেউ নয়। স্থবিরতা, অস্থিরতা আবার স্ফুর্তি এই সবই দুনিয়ার স্রোতধারা। এই স্রোতধারায় কোনো কোনো বীর টিকে যায় সম্মুখ যুদ্ধে, কোনো কোনো বীর নেপথ্যে। জয়ী হয় সাহসী। কিন্তু অর্থ-বাণিজ্যের নিয়ম ধারা নিরাপত্তার নাগপাশে পিষ্ট হয়।
জহুরুল ইসলামও তাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীন থাকতে পারলেন না। ১৯৬০-৭০ সালের দশকজুড়ে তিনি এক উৎকর্ষের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সবেমাত্র স্বাধীন বণিক হিসেবে স্থিতি পেতে শুরু করেছিলেন। সেই মুহূর্তের যুদ্ধ তার স্বাধীন বণিকে থিতু হতে দিল না। যাহোক, বড় স্বাধীনতার আগে সাময়িক পরাধীনতার ডুবোজল মানুষকে সহিষ্ণু করে তোলে। যুদ্ধের শুরু হলে জহুরুল ইসলাম আর দেশে থাকতে পারলেন না। বাধ্য হলেন দেশ ছাড়তে।
তিনি এ সময় লন্ডনে অবস্থান করেন। এ সময় যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বাঙালিরা হাইড পার্কে বিক্ষোভ করছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তখন জেনেভা সফর শেষে লন্ডনে অবস্থান করেন। যাহোক, এই আন্দোলনকারীরা ছিলেন স্বল্প আয়ের বাঙালি প্রবাসী। সাঈদ চৌধুরী আন্দোলনে যোগ দিলেন। তবে প্রথমদিকে তাদের আন্দোলন ছিল বিক্ষিপ্ত ও অসংগঠিত। তাই সাঈদ চৌধুরী তাদের সংগঠিত করার একটি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। কিন্তু সংগঠিত করার পরে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার জন্য অর্থের সংকট দেখা দিল। কেননা একটি কেন্দ্রীয় দফতর ছাড়া আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়া যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি আন্দোলনকে বেগবান করাও যাচ্ছিল না। প্রবাসীরা তখন দু-এক পাউন্ড করে দেওয়া শুরু করলেন। কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। এই চাঁদার তহবিলে একটি বাড়ি ভাড়া করাও যাচ্ছিল না।
এ সময়ের মধ্যে লন্ডনের সব বাঙালি কূটনীতিক ডিফেক্ট করে পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দেন এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ফলে তারা তখন কোনো আয়-রোজগারের ভেতর ছিল না। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছিলেন। এ রকম শোচনীয় অর্থ-কষ্টের মধ্যে মহীউদ্দিন আহমেদকে তলব করলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। লন্ডন হাইকমিশন থেকে যারা ওই সময় ডিফেক্ট করেছিলেন, তাদের মধ্যে মহীউদ্দিন আহমেদ ছিলেন অগ্রনায়ক। পরবর্তীকালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব হন। বর্তমানে লেখক ও কলামিস্ট। যাহোক, মহীউদ্দিন আহমেদ এলেন। বিচারপতি সাঈদ চৌধুরী তখন তার হাতে তুলে দিলেন পাঁচ হাজার পাউন্ড। তখনকার দিনে পাঁচ হাজার পাউন্ড বিশাল অর্থ।
এত টাকা দেখে মহীউদ্দিন আহমেদ অবাক হয়ে যান। তিনি প্রশ্ন করলেন ‘স্যার, টাকাটা কার নামে লিখে রাখব?’ বিচারপতি চৌধুরী বললেন, ‘নাম জানতে হবে না। লিখে রাখো সুবিদ আলী।’ কে এই সুবিদ আলী নেপথ্যে অর্থ জোগান দিচ্ছেন প্রবাসী বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনে? এসব প্রশ্নের জবাব জানা ছিল না মহীউদ্দিনের। দীর্ঘদিন পরে যুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো। এরপর সাঈদ চৌধুরী দেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলেন। ফলে দেশে ফেরার দিন মহীউদ্দিন আহমেদকে ডেকে হাসতে হাসতে আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘সুবিদ আলী হচ্ছেন শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম।’ গল্পটি জহুরুল ইসলামের ইন্তেকালের পর মহীউদ্দিন তার প্রতিশ্রদ্ধা নিবেদনস্বরূপ পত্রিকায় লিখেছিলেন।
এই যুদ্ধের দিনে তিনি সশরীরে যুদ্ধে অংশ নেননি। আবার ব্যবসাও চালিয়ে নিতে পারেননি। কিন্তু লন্ডনে বসে তিনি আর্থিকভাবে যুদ্ধের পেছনে অর্থ দান করে গেছেন। ছোট ভাই শফিউল ইসলাম কামাল তার ব্যবসার দেখভাল করতে থাকেন।

গবেষক, শেয়ার বিজ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০