কাজী সালমা সুলতানা: ৮ মার্চ, ১৯৭১। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এদিন সারাদেশে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহল্লায়-মহল্লায়, বাসভবনে, ছাত্রাবাসে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। এমনকি সরকারি-বেসরকারি যানবাহন ও প্রাইভেট মোটরগাড়িতেও কালো পতাকা লাগানো হয়। এদিন সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়। অন্যান্য বেতারকেন্দ্র থেকেও তা প্রচার করা হয়।
ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহসভাপতি
আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, আমরা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এ রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষিত নির্দেশের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় বিভাগগুলো খোলা থাকবে। সার সরবরাহ ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। পোস্ট অফিস সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে। পানি ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
তাজউদ্দীন আহমদ পৃথক আরেক বিবৃতিতে ৭ মার্চ সামরিক শাসকের জারি করা প্রেসনোটের প্রতিবাদ জানান। সামরিক শাসকের প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় এদিন ১২৭ জন নিহত ও ৩৫৮ জন আহত হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ একটি বিবৃতিতে বলেন, প্রেসনোটে হতাহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে বলা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ক্ষেত্রেই গুলিবর্ষণ করা হয়েছে বলে কথিত বক্তব্য সত্যের অপলাপ। নিজেদের অধিকারের সপক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীর ওপরই নিশ্চিতভাবে গুলি চালানো হয়েছে। পুলিশ ও ইপিআর গুলিবর্ষণ করেছে বলে যে কথা প্রেসনোটে বলা হয়েছে, তা বাঙালিদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।
এদিন ব্রিটেনে প্রবাসী ১০ সহস াধিক বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ইসলামাবাদে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দেয়া শর্ত সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
এদিকে পিডিপি সভাপতি নূরুল আমিন এক বিবৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুষ্ঠু পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান। একই সঙ্গে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর এক বিবৃতিতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধুর দাবির প্রতি সমর্থন জানান এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের দায়ী করেন। এদিন জেনারেল টিক্কা খানকে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের একটি সভা এদিন তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ৪২ বলাকা ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ছাত্রলীগ প্রদেশের সব প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি পতাকা প্রদর্শন, পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানো এবং উর্দু চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখা ও সিনেমা কর প্রদান না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ছাড়া এদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘ছাত্রলীগ’ নাম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এদিন গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) এম আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। বেতার ও টিভি শিল্পীদের একটি প্রতিনিধিদলও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও সাক্ষাৎ করেন সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। তারা বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত মোতাবেক অফিসের কাজ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ব্রিগেডিয়ার জিলানির মাধ্যমে প্রেরিত এক লিখিত বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান, ‘আপনি যা দাবি করেছেন তার চেয়ে বেশি কিছু দিতেও আমার আপত্তি নেই। আমি অচিরেই ঢাকা আসছি।’