কাজী সালমা সুলতানা: ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১, এদিন মুক্ত হয় বরিশালের গৌরনদী এলাকা। ২৮ দিন মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর আক্রমণের পর গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পে অবস্থানরত শতাধিক পাকিস্তানি সেনা মিত্রবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করে। উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। এর আগে আগৈলঝাড়ার ছয়টি ও গৌরনদীর চারটি বধ্যভূমিতে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করে গণকবর দেয় পাকিস্তানি সেনারা।
এদিন পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা বরখাস্ত হন। এর মধ্যে চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান ও নিরাপত্তা সচিব মেজর জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠা, মেজর জেনারেল খোদা বখশ, মেজর জেনারেল কায়ানি ও এয়ার মার্শাল রহিমকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেয়া হয়। এছাড়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো নৌবাহিনীর ছয় অফিসারকে বরখাস্ত করেন।
১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর অপরাহ্নে মুজিবনগর সরকারের নেতা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের সাত সদস্য ভারতীয় বিমানবাহিনীর ক্যারিবু পরিবহন বিমানে করে ঢাকায় এসে পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাদের বিপুলভাবে সংবর্ধিত করা হয়। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা ও তার আশু করণীয় নির্ধারণে ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা সচিবদের সমন্বয়ে যে সাব-কমিটি গঠন করেছিল, সেই কমিটি ও পরিকল্পনা সেল পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলছে। ফলে বেসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন, খাদ্য ও জ্বালানিসহ জরুরি পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়করণ, সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্র পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়া, জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ, সচিব সাব-কমিটি ও পরিকল্পনা সেলের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন, মন্ত্রিসভায় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের পর জেলা পর্যায়ে জরুরি করণীয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশপত্র পাঠানো হয়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিচালিত গণহত্যার জন্য যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও অন্যান্য অভিযোগে যারা অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন জেনারেল, একজন ব্রিগেডিয়ার, তিনজন কর্নেল, দুজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেন। এছাড়া দ্বিতীয় আরেক তালিকায় ১২ অভিযুক্তের নাম আছে। এ তালিকা প্রণয়ন তখনও চলছিল।
রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে। জুলফিকার আলি ভুট্টো জানান, তিনি শিগগিরই চীন সফরে যাবেন। বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে স্বল্পসংখ্যক অফিসার ও কর্মচারীর উপস্থিতিতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ঢাকার অফিস খুলতে শুরু করে। সারা পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হতে থাকে। মি. ভুট্টোকে দেশে ফেরানোর জন্য ওয়াশিংটনে জরুরি তলব পাঠানো হয়েছে মর্মে খবর জানা যায়।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ’৭১-এর দশ মাস