কাজী সালমা সুলতানা: ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন ৫৪ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে, তার পূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানান। তারা বলেন, যারা এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস বর্বরতার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের কোনোমতেই জেনেভা কনভেনশনের ছত্রছায়ায় থাকতে দেয়া যেতে পারে না। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন কবি সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলী আহসান, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, সমর দাস, এবিএম মূসা, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ। বুদ্ধিজীবীরা এসব নরপিশাচকে বিচার করার জন্য বিশ্বের প্রখ্যাত আইনবিদ ও মনীষীদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের আবেদন জানান।
এদিন বিবিসির এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বাংলাদেশে সামরিকভাবে বিপর্যস্ত এবং পশ্চিম পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত বরাবর যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে তদন্তের জন্য বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। লন্ডনে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউমের সঙ্গে আলোচনাকালে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জানান, বাংলাদেশে প্রয়োজনের চেয়ে এক দিনও বেশি সৈন্যদের রাখার কোনো ইচ্ছা ভারতের নেই। এদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো নৌবাহিনীর ছয় শীর্ষ অফিসারকে বরখাস্ত করেন।
এদিন ২৫ মার্চ-পরবর্তী সময়কার দখলদার পাক বাহিনীর বর্বরতার দোসর শতাধিক দালালকে ধরা হয়েছে বলে জানা যায়। পুলিশ ডিরেক্টরেটের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাতে এপিবি ও বিপিআই গ্রেপ্তারকৃতদের নাম ঘোষণা করেÑ১. ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ভিসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ২. এসএম নওয়াব, পুলিশের ডিআইজি; ৩. ফজলুল হক, এমএনএ; ৪. লে. কর্নেল গোলাম আহমদ চৌধুরী, ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার; ৫. মেজর আফসার উদ্দিন, সাবেক পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি; ৬. জহুরুল হক, ডেপুটি ডিরেক্টর, রাজাকার; ৭. ডক্টর এএ বাসেত, ঢাকা মেডিকেল কলেজ; ৮. এবিএম নূরুল ইসলাম, এমএনএ; ৯. এসবি জামান, এমপিএ; ১০. এবিএম আব্দুল খালেক মজুমদার, বদর নেতা; ১১. মোক্তার গুণ্ডা, মিরপুর মুজাহিদ পার্টির কমান্ডার; ১২. আশরাফ আলী, বদর সদস্য; ১৩. চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী; ১৪. হাকিম ইনতাজুর রহমান আখুনজাদা, কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য; ১৫. ইন্সপেক্টর আব্দুল হালিম সিকদার, সিআইএ কোতোয়ালি; ১৬. এসআই কায়কোবাদ, সাবেক ওসি, লালবাগ থানা; ১৭. এসআই খোরশেদ খাঁ, সাবেক ওসি, লালবাগ থানা এবং ১৮. মাওলানা বজলুর রহমান, ফরিদাবাদ মাদরাসা, ঢাকা।
ভারতের পুনর্বাসন সচিব সিএস কাহলোন জানান, কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন শুরু হবে এবং বিদায়কালে প্রত্যেক শরণার্থীকে দুই সপ্তাহের রেশন দেয়া হবে। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা জানান, আলোচনার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে আসা হয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংকল্প প্রকাশ করে যে, স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি আ স ম আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১-এর দশ মাস