কাজী সালমা সুলতানা: ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঢাকায় বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার জন্য ভুট্টোর প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে এক মিনিটও আটক রাখার অধিকার ভুট্টোর নেই। ভুট্টো যদি জনগণের ভালো চান, তাহলে তার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়ার মতো বাস্তব মনোভাব ও সাহসিকতা থাকা প্রয়োজন। তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্ব সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, কোন ক্ষমতাবলে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট, তা তিনি জানেন না। তিনি ভুট্টোকে পূর্ব পাকিস্তান পুনর্দখলের রঙিন স্বপ্ন ত্যাগ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যত দিন মানবসভ্যতা থাকবে, তত দিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে।
তিনি বলেন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যদি তাদের মনোভাব পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকার এ দুটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করবে। তিনি দুই দেশের জনগণের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুটি দেশের জনগণের সমর্থন ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থনের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর টেড কেনেডি, সিনেটর সেক্সবি, সিনেটর ফ্রাঙ্কচার্চ, কংগ্রেস ম্যান কালাহান ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রগুলোর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থনের জন্য তিনি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পোল্যান্ডের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
এদিন ভারতের মেজর জেনারেল ও মুজিববাহিনী প্রধান সুজন সিং উবান বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন শেখ মণি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। ঢাকাস্থ সোভিয়েত কনসাল ডিএফ পোপোভ বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বড়দিন উপলক্ষে সোভিয়েত জনগণের পক্ষ থেকে বেগম মুজিবকে উপহার প্রদান করেন।
এদিন ঢাকায় মসজিদ, মন্দির, চার্চ ও প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনা, শোভাযাত্রা এবং বিকালে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্র প্রযোজক জহির রায়হান অভিযোগ করেন, বদর বাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে একটি বৃহৎ শক্তি জড়িত আছে।
তিনি স্থানীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড শুধু বদরদের দ্বারা সম্ভব হয়নি, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সার্ভিস কর্তৃক ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান ও কঙ্গোয় পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এর প্রায় মিল রয়েছে।
জহির রায়হান বলেন, লে. নিয়াজিসহ কিছু পাকিস্তানি জেনারেল এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীও এ ষড়যন্ত্রের দোসরের কাজ করেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এখনও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
খুনি ও অপরাধী ব্যক্তিরা এরই মধ্যে জনগণের বিভিন্ন অংশে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তার কাছে অপরাধীদের পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা রয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র ও হত্যারহস্য সারাবিশ্বের কাছে উš§ুক্ত করতে সরকারের কাছে আবেদন জানান। তিনি বলেন, বদর দস্যুদের মুখোশ উšে§াচন না করলে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি তা হুমকি হয়ে থাকবে। তাদের কঠোর হাতেই দমন করতে হবে। বদর পশুদের জঘন্য হত্যাকাণ্ডে দেশ তার সেরা সন্তান-সন্ততিদের হারিয়েছে।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর