স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে

কাজী সালমা সুলতানা: ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিনে বরগুনাবাসী হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বরগুনা ছিল নবম সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বরগুনার বিভিন্ন থানা ও তৎকালীন মহাকুমা সদরে পাক বাহিনী অবস্থান করে নারী নির্যাতন ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।

এদিন দিবাগত গভীর রাতে লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে পাক বাহিনীর ওপর ভারতীয় সৈন্য বিমান ও নৌ বাহিনী। তাদের সঙ্গে মুক্ত এলাকা থেকে যোগ দেয় বাংলার মুক্তিবাহিনী। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রথম সফল হামলা করল রাত ১১টা ৩০ মিনিটে, তারা গোদনাইল (নারায়ণগঞ্জ), চট্টগ্রাম  ফুয়েল পাম্প শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরপর থেকে সম্মিলিত ভারত বাংলাদেশের বোমা বর্ষণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তেজগাঁও, কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার এলাকায়। এই আক্রমণে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের কর্মক্ষমতা অর্ধেকটাই ধ্বংস হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীই এ আক্রমণের সূচনা করে। পরবর্তী ১৮ ঘণ্টায় বাংলাদেশ ভারত মিত্রবাহিনী লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পঙ্গু করে দেয়।

এদিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় প্যারেড গ্রাাউন্ডের জনসভায় ভাষণ দেন। স্মরণকালের  বৃহৎ জনসভায় পরিণত হয় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভা। এই জনসভায় ভাষণদানকালে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিপুর, উত্তর লাই, আগ্রাসহ বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানের বিমান আক্রমণ শুরু হয়। বক্তব্য শেষ করেই দিল্লি ফিরে যান শ্রীমতি গান্ধী। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত ধারা। বাংলাদেশ ভারত ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ে।

ভারতীয় বিমান সে রাতে ১৭০ বার কুর্মিটোলা যশোর, কুমিল্লা লারমনিরহাট, বাংলাদেশের সব বিমানবন্দরের ওপর  আক্রমণ চালায়। এই বিমান আক্রমণে পাক বাহিনীর ১০টি এফ ৮৬ স্যাবর জেট (ঢাকায় ৪টি, যশোরে ৩টি, লারমনিরহাটে ৩টি আকাশ যুদ্ধে ভূপাতিত হয়।) বোমাবর্ষণে রানওয়েগুলোতে ছোট ছোট পুকুর তৈরি হয়ে যায়। কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে প্রায় ৫০ টন বোমা বর্ষণ করা হয়। সেদিন ঢাকায় সান্ধ্য  আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়।

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামের আমির অধ্যাপক গোলাম আজম রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, কোয়ালিশন দলের প্রধান নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হলে তার কোনো আপত্তি নেই। কেননা বাংলাদেশ ‘তামাশা’ বন্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা উচিত।

 মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়Ñযশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুরের কয়েকটি উপজেলা তারা দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমগ্র বাহিনী মিত্রবাহিনীকে সহযোগিতায় প্রস্তুত ছিল। এর মধ্যে নিয়মিত ব্রিগেডের সঙ্গে কে ফোর্স, এস ফোর্স ও জেড ফোর্স যোগ দেয়। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যৌথবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত হয়।

মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, তিনি বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা হয়। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পুনরায় পাকিস্তান আসতে রাজি হন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্টে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ভারত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনে ও ভারত সীমান্তে পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে ভারতের নিরাপত্তা বিপদসংকুল হয়ে পড়ে।

৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পুর্বাঞ্চল কমান্ডর লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী হয় মিত্রবাহিনী । তারা একসঙ্গে পাক বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে  লিপ্ত হয়। এদিন থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব। 

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর , মূলধারা ৭১, ৭১-এর দশ মাস।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০