কাজী সালমা সুলতানা: ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র বাংলা সংবাদ বুলেটিন প্রচার করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও সকাল-সন্ধ্যা যুদ্ধ সমীক্ষা, দেশাত্মবোধক গান ও চরমপত্র প্রচার করা হয়।
এই দিন মুক্ত হয় যশোর, গাইবান্ধা, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, শেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, যশোর, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, সিলেটের অনেক এলাকা, মুক্ত হয় চান্দিনা ও জাফরগঞ্জ। এ সময় দেশ শত্রুমুক্ত করতে সাতক্ষীরার বীর সন্তানরা অন্তত ৫০টি ছোট-বড় যুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলা করে।
লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন এসব এলাকার মুক্তিকামী জনতা। নিয়াজীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দুর্গ যশোরের পতন ঘটে। ভারতের নবম ডিভিশন এদিন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যশোর অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়ে দেখতে পায়, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ও রসদভর্তি সুরক্ষিত বাঙ্কার সম্পূর্ণ জনশূন্য।
যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সব পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে গেছে। পলায়নের সময় পাকিস্তানি বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, রেশন এবং কন্ট্রোল রুমের সামরিক মানচিত্রও ফেলে রেখে যায়। এ ঘটনায় সারাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যশোরের এ ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ারও মনোযোগ আকর্ষণ করে ব্যাপকভাবে।
যশোর থেকে ঢাকা অথবা খুলনার দিকে বিক্ষিপ্ত পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যরাই অন্যান্য স্থানে স্বপক্ষীয় সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। দু-তিনটি স্থান বাদে সর্বত্রই পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষার আয়োজনে ধস নেমে আসে। ভারতীয় বাহিনী সিলেটে হেলিকপ্টারে অবতরণ করার পর মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় সিলেট শহর মুক্ত করে।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ছিল বাঙালির গণতন্ত্রের বিপ্লবের দিন। এদিন বাঙালি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয় নেতা নির্বাচন করেছিল। আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলার শুভ অভ্যুদয়।
ভুটান স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। অপরাহ্ণে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। এর ফলে পাকিস্তান সরকার ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ এক বিবৃতিতে বলেন, যদি ভারত ও পাকিস্তান দুই যুদ্ধরত দেশ অনুরোধ করে তাহলে এই সংঘর্ষ মধ্যস্থতা করতে রাজি আছে। সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ কোনো প্রকার বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পাক-ভারত সংঘর্ষের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
সকালে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডার চিফ স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। আকাশে মিত্রবাহিনীর বিমান গর্জন আর্তনাদ। রাজাকার-আলবদরদের পৈশাচিক রুদ্ধশ্বাসকর পরিস্থিতি ঢাকা নগরীর। রাতের অন্ধকারে ডুবে আছে শঙ্কিত বাঙালিরা।
গোপালগঞ্জেও যশোরের মতো ঘটনা ঘটে। চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ বলয় রচিত হওয়ার খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা গোপালগঞ্জ সদর থানা উপজেলা পরিষদ (বর্তমানে) সংলগ্ন জয় বাংলা পুকুর পাড়ের মিনি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর মুক্তিসেনারা শহরের দিকে আসছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিকামী জনতার মনে সেদিন আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।
এদিনে চিরিরবন্দরেও পাক বাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই-সংগ্রামে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে যায়। চুয়াডাঙ্গাও সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত হয়। বিকালে সড়কের করতোয়া সেতু দখল করে নিয়ে পাকিস্তান ও যৌথবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মূলধারা ৭১ ও ৭১-এর দশ মাস
ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী