স্বাভাবিক আমদানিতেও সরবরাহ অস্বাভাবিক

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশে বার্ষিক চিনির চাহিদা প্রায় ২২-২৩ লাখ টন। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশের বেশি আমদানির মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করা হয়। বাকিটা সরকারি চিনিকল থেকে পাওয়া যায়। যদিও দেশীয় চিনিকল থেকে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সংকটকে পুঁজি করে বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো দেশের চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না চিনির দাম। এতে অস্বাভাবিক দামে ক্রেতাদের চিনি কিনতে হচ্ছে।  

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৩০ জানুয়ারি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯১৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপের মেঘনা সুগার রিফাইনারি প্রায় ৮ লাখ ৫৪ হাজার টন চিনি আমদানি করে শীর্ষ অবস্থানে আছে। সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ চার লাখ ২৩ হাজার টন, এস আলম রিফাইন্ড সুগার দুই লাখ ৮১ হাজার টন, আব্দুল মোমেন সুগার রিফাইনারি এক লাখ ৫ হাজার টন এবং দেশবন্ধু সুগার মিলস ৭৩ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। এছাড়া অন্য আমদানিকারকরা দেড় লাখ টন চিনি আমদানি করে। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পুরো অর্থবছরের চাহিদার কাছাকাছি চিনি আমদানি হয়েছে। আবার এপ্রিলে সরকার খোলা চিনির দাম প্রতি কেজি ১০৪ টাকা বেঁধে দিয়েছিল। এর আগে বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ কমিয়ে দেয় এনবিআর। এতেও পাইকারি পর্যায়ে চিনির দাম কমেনি। সর্বশেষ সরকারিভাবে চিনির দাম কেজিপ্রতি আরও কমিয়ে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপরও স্থিতি ফেরেনি চিনির পাইকারি বাজারে, বরং বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এক সময় দেশে চিনির বার্ষিক উৎপাদন ছিল প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টন। এসব চিনি সরকারি ১৫টি মিলে উৎপাদন হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেশে চিনি উৎপাদন বাড়েনি। বরং আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে কয়েক গুণ। অপরদিকে দুই বছর ধরে ছয়টি সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে উৎপাদন নেমে এসেছে ২৫ হাজার টনে। অর্থাৎ সরকারি চিনি সরবরাহ কার্যত বন্ধ থাকায় বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো দেশের চিনির বাজারে দাম নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করছে।

চিনি ব্যবসা-সংশ্লিষ্টরা বলেন, গত বছরের জুলাই থেকে চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় গত সেপ্টেম্বরে সরকার প্রথমবারের মতো চিনির দাম বেঁধে দেয়। এরপর অক্টোবর ও নভেম্বরে দুই দফা দাম বাড়ানো হয়। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে তিন দফায় প্রতি কেজি ২৩ টাকা বেড়েছে। গত ৬ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনির দাম পুননির্ধারণ করে। নতুন করে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ১০৪ টাকা ও মোড়কজাত চিনির দাম ১০৯ টাকা বেঁধে দেয়া হয়, আগে যা ছিল যথাক্রমে ১০৭ ও ১১২ টাকা।

সরেজমিনে গতকাল বুধবার সকালে খাতুনগঞ্জ পাইকারিতে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনি বিক্রি হয় ৪ হাজার ৬০০ থেকে ৪ হাজার ৬৫০ টাকায়। গতকাল এক দিনের ব্যবধানে দাম বেড়ে দেড় হাজার টাকা; যা আগের দিন ছিল চার হাজার ৫০০ টাকা। আর ঈদের আগে ছিল মণপ্রতি চার হাজার টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, বাজারে প্রতি কেজি চিনি ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি আছে। তবে কিছু কিছু দোকানে কেজিপ্রতি চিনি ১৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অনেক দোকানে বিক্রেতারা জানিয়েছেন, তাদের কাছে হয় চিনির সরবরাহ নেই কিংবা তারা চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন।

খাতুনগঞ্জের চিনির পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে চিনির মণপ্রতি দাম ৬৫০ টাকা

 বেড়েছে। আর এক দিনে বেড়েছে ১৫০ টাকা। অথচ বিপুল পরিমাণে চিনি দেশে আমদানি হয়েছে। কিন্তু মিলমালিকরা নিয়মিত বাজারের সরবরাহ করছে না। নানান অজুহাতে চিনির দাম বাড়িয়ে যাচ্ছেন। সরকারের উচিত কঠোরভাবে তাদের দমন করা।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম অনেক বেড়ে গেছে, তাই বর্ধিত দামে চিনি আমদানি করবে কি না, সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন এক চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চেয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন চিনির দাম ৬৭৫  ডলার। এক মাস আগেও তা ছিল ৫২০ ডলার। এ কারণে  সংগঠনের সদস্যরা চিনি আমদানিতে এলসি খুলতে ‘ভীতির সম্মুখীন’ হচ্ছেন। তারা বলছেন, ৬৭৫ ডলার দরে প্রতি মেট্রিক টন আমদানি করলে চিনির আমদানি মূল্য পড়ে প্রতি কেজি ১৩১ টাকা; যার মধ্যে রয়েছে সরকারের শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য কর বাবদ কেজিতে ৩৫ টাকা।

একটি চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, তিন দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আবার আমাদের ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে, এলসি পেতে কষ্ট হচ্ছে, সাগরের অনেকদিন জাহাজ পণ্য খালাসে অপেক্ষায় ছিল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, রমজানে বিদ্যুৎ সংকট ছিলÑসবমিলিয়ে চিনির বাজারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে ঈদের ছুটিতে কারখানায় পরিশোধের কাজ সেøা ছিল। এমনকি ডেলিভারিও সেøা ছিল। যার প্রভাবে দাম একটু বেড়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ে চিনির দাম সহনশীল অবস্থায় আসবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০