খোন্দকার মাহ্ফুজুল হক: ১৯২৩ সালে মহাত্মা গান্ধী এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন। বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি বললেন, স্যানিটেশন স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। উপস্থিত শ্রোতারা এ কথা শুনে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু গান্ধীজি তার কথার ওপর অটল থেকে বক্তৃতা দিতে লাগলেন।
স্যানিটেশন হলো নিরাপদ খাওয়ার পানি এবং মানববর্জ্য ও ব্যবহƒত পানি যথাযথ নিষ্কাশন সংক্রান্ত গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। মলমূত্রের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ রোধও স্যানিটেশনের একটি অংশ। স্যানিটেশনের অপরিহার্য শর্ত হলো নিরাপদ পানি, হাত ধোয়া, টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সচেতনতা, নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্যানিটেশন টার্মটিকে বিবৃত করেছে, ‘মানব মল ও মূত্রের নিরাপদ নিষ্কাশনে যথাযথ ব্যবস্থা এবং সুবিধা প্রদানের মধ্যমে স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা বলে’। স্যানিটেশনে প্রকৌশল অবকাঠামোর উপাদানগুলো হলোÑমানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিষ্কাশিত পানি ব্যবস্থাপনা, দূষিত মাটি ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির পানির জন্য নালা ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিগুলো। জাতিসংঘের পানি সরবরাহ এবং সহযোগী কাউন্সিল স্যানিটেশনের ব্যাখ্যায় বলেছে স্যানিটেশন হলো মানববর্জ্য, ঘরের ব্যবহƒত ময়লাপনি, দূষিত মাটির সংরক্ষণ বা উপযুক্ত স্থানে স্থানান্তর, যথাযথ প্রতিবিধান এবং তদসম্পৃক্ত স্বাস্থ্যবিধি উৎসাহিতকরণ।
স্যানিটেশনের উদ্দেশ্য হলো সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তোলা, প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর সংরক্ষণ, মানববর্জ্য-সংশ্লিষ্ট সুবিধা ও নিরাপত্তা প্রদান। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০১০ সালে পানি ও স্যানিটেশনে মানবাধিকার (ঐজডঝ) স্বীকৃতি পায় এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনেও স্বীকৃত হয়। ফলে এটি মানবাধিকার থেকে শুরু করে একটি উপযুক্ত জীবনমান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়া স্যানিটেশন হলো বৈশ্বিক উন্নয়নের একটি পূর্বশর্ত এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-৬ এর একটি অংশ। ২০১৬ সালে বিভিন্ন দেশের স্যানিটেশনকে তুলনা করতে ‘পর্যায়’ নির্ধারণ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত সমন্বিত পর্যবেক্ষণ অভিযান (ঔগচ) স্যানিটেশনের ধাপ বা পর্যায় নির্ণয় করে। অনুন্নত, সীমিত এবং নিরাপদ এ তিনটি ধাপ দিয়ে তা সূচিত করা হয়। এতে দেখা যায়, এ ধাপগুলো শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই ব্যবহার হচ্ছে। এতে আরও উঠে আসে যে, সাড়ে চার বিলিয়নের মতো মানুষ পৃথিবীতে এখনও নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা পায়নি। উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব গণস্বাস্থ্যকেই শুধু হুমকিতে ফেলছে না, বরং মানব বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকেও ক্ষুন্ন করছে।
অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন বিশ্বব্যাপী ৪.০ শতাংশ মৃত্যু এবং ৫.৭ শতাংশ রোগের জন্য দায়ী বলে অনুমান করা হয়। ২০১১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ শিশু ডায়রিয়ায় মারা যায়। প্রতি বছর এ বয়সী শিশু মারা যায় ২ হাজার জন এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন করে মারা যায়। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এস্টিমেশন অনুযায়ী পাঁচ বছরের কম বয়সী ৮৬,০০০ জন শিশু অনিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, হাত ধোয়া ও পানি বিশুদ্ধকরণের সঠিক চর্চা থেকে বঞ্চিত। এটি করা হলে প্রতি বছর ডায়রিয়ায় অক্রান্ত হওয়া ১৫ লাখ শিশুর মৃত্যু রোধ করে তাদের সুস্থ জীবন প্রদান করা যেতে পারে।
স্যানিটেশন এবং হাইজিনের অভাবজনিত সৃষ্ট রোগ-ব্যাধি হলোÑপানিবাহিত রোগ, মলমূত্র থেকে সংক্রমিত রোগ, শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, হ্রাস বাধাপ্রাপ্ত হওয়া এবং শিশুদের অপুষ্টি ইত্যাদি। ভারতে কতগুলো রোগের তালিকা করা হয়েছে, যেগুলো স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে বিস্তার হ্রাস করা যেতে পারে। রোগগুলো হলোÑরক্তস্বল্পতা, অ্যাস্কারিয়াসিস, কলেরা, ক্যামপাইলোব্যাক্টোরিওসিস, সায়ানোব্যাক্টোরিয়ার বিষক্রিয়া, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস, জাপানি এনসেফালাইটিস (ঔঊ), লেপ্টোস্পাইরোসিস, ম্যালেরিয়া, রিং-ওর্ম (ছত্রাকজনিত এক ধরনের রোগ), স্ক্যাবিস, সিসটোসোমায়োসিস, ট্রাকোমা, টাইফয়েড জ্বর, শিজেলোসিস, পোলিও ইত্যাদি। আমাদের দেশেও এগুলোর প্রাদুর্ভাব লক্ষ্যণীয়। চলমান করোনা মহামারি প্রতিরোধে স্যানিটেশন সিস্টেম মেনে চলার অপরিহার্যতা সর্বজনস্বীকৃত।
প্রধান ও প্রথম মানব বসতিগুলো পানির উৎস নদী বা প্রাকৃতিক ঝরনার কাছাকাছি স্থানেই বিকাশ লাভ করেছিল। এর কারণ হলো বর্জ্য পানির উৎসে ছেড়ে দেয়া, যাতে করে তা পানিতে মিশে যায় এবং স্রাতের টানে ভেসে চলে যায়। এশিয়ার সিন্ধু উপত্যকার ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা (৩৩০০-১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এর একটি উদাহরণ। প্রাচীন রোমে স্যানিটেশন ব্যবস্থায় ড্রেনগুলো ছিল পাথর এবং কাঠ নির্মিত। রোমের টাইবার নদীতে ক্লোকা ম্যাক্সিমা তার নিদর্শন এখনো বহন করছে। যেগুলো খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ এবং ৭৩৫ অব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। তবুও দুর্বল স্যানিটেশনের প্রভাবে তাদের মধ্যে হেলমিন্থ (অন্ত্রের কৃমি), ডায়রিয়া ও ডিসেন্ট্রির সমস্যা বিরাজমান ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে দুর্বল স্যানিটারি ব্যবস্থাপনার ফলে প্লেগ এবং কালো মড়ক মহামারিতে লাখ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। তখন শিশু মৃত্যুর হারও ছিল উচ্চ।
বর্তমান বিশ্বে স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনার অনেকগুলো ধরন দেখা যায়। যেগুলো হলোÑবেসিক স্যানিটেশন, কনটেইনার স্যানিটেশন, কমিউনিটি লেড টোটাল স্যানিটেশন, শুষ্ক স্যানিটেশন, বাস্তুতান্ত্রিক স্যানিটেশন, জরুরি স্যানিটেশন, পরিবেশগত স্যানিটেশন এবং উন্নত ও অনুন্নত স্যানিটেশন। সবগুলোর উদ্দেশ্যই হলো স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সেবা প্রদান।
অনুমান করা হয়, ২০১৫ সালেও ২৪০ কোটি মানুষ উন্নত স্যানিটেশনের অভাবে ভুগছে। ২০০৬ সালের জেএমপি এবং ইউএনডিপি’র প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এমডিজি স্যানিটেশন লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি বেশ মন্থর এবং পূরণীয় লক্ষ্যমাত্রা ও বাস্তবতার মধ্যে বৃহৎ ব্যবধান বিরাজ করছে। এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছে, রাজনৈতিকাভাবে নজর না দেয়া এবং স্যানিটেশন কর্মসূচিকে গুরুত্ব না দেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়নের (৯৪৬ মিলিয়ন) কম লোক এখনও খোলা স্থানে মলত্যাগ করছে এবং ১৯৯০ থেকে ২০১৫ এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী খোলা স্থানে মলত্যাগের হার ৩৮ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী শহরাঞ্চলের জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ এবং গ্রামীণ জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার অগ্রগতি হলেও নিশ্চিত করা এখনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। দেশে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সুযোগ পাচ্ছে ৫৫.৯ শতাংশ মানুষ। ২০১৩ সালে ইউনিসেফের পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, একই টয়লেট একাধিক ব্যক্তি ও পরিবারের ব্যবহারের হার অনেক বেশি এবং শহরের বস্তিগুলোতেই তা সবচেয়ে বেশি। ৫৯.১ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেন। ঢাকা ছাড়া অন্য কোনো শহরেই রীতিসম্মত স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা নেই। প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে মাত্র দু’টি পরিবার শিশুর মলমূত্র ঠিকমতো সরিয়ে ফেলে। ৮৪ শতাংশ বিদ্যালয়ে শৌচাগার থাকলেও মাত্র ২৪ শতাংশ উন্নত ও পরিচ্ছন্ন। ধনীদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারে অনুন্নত স্যানিটেশন ব্যবহারের হার ১০ গুণ বেশি। মাত্র ২২ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগ নেই।
স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের অপরিহার্যতা নিশ্চিতে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংস্থাগুলো নিরলস কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনডিপিসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো ব্যক্তিগত সংস্থাও বিশ্বব্যাপী স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন দেশের সরকারও তাদের নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রার আলোকে নিজ নিজ দেশে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন কর্মসূচিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মকভাকে কাজ করছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ৬.১ এবং ৬.২ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পূরণ হবে বলেও সরকার আশাবাদী। লক্ষ্যমাত্রার আলোকে সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ১৫ কোটি ডলার এবং বেসরকারি খাত থেকে প্রায় ১৩ কোটি ডলার সহায়তার অঙ্গীকার পেয়েছে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের কছে সুপেয় পনি এবং স্যানিটেশন পৌঁছে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে ২০২২ সালে আর্সেনিক দূষণ-আক্রান্ত এলাকায় দূষণমুক্ত পানি নিশ্চিত করা, নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি ও ৭৫ শতাংশ জনগণকে বেসিক স্যানিটেশন কভারেজ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পানি ও স্যানিটেশন খাতে সরকারের বার্ষিক বরাদ্দ প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি ও বাজেট গ্যাপ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে।
সুপেয় পানির জন্য প্রত্যেক জেলায় টেস্টিং ল্যাব প্রতিষ্ঠা, পৌর এলাকার পাশাপাশি গ্রাম অঞ্চলে পানি সরবরাহের জন্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ, ভূ-উপরিস্থ পানি বা সারফেস ওয়াটারের ব্যবহার প্রাধান্য দেয়া, পিছিয়ে পড়া ৬ অঞ্চলের মানুষের জন্য পানি ও স্যানিটেশন সেবা নিশ্চিতকরণে ‘এনহ্যান্সিং গভর্নেন্স অ্যান্ড ক্যাপাসিটি অব সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি ইন ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন সেক্টর’ প্রকল্প সরকারের নেয়া উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপেরই অংশ। এ ছাড়া সরকার ‘জাতীয় পানি ও স্যানিটেশন কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করেছে।
শহর এবং গ্রামে পানি ও স্যানিটেশন বৈষম্য দূর করে সেবা নিশ্চিত করতে সরকার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উল্লেখযোগ্য সেবা প্রদান করছে। প্রদেয় সেবার আওতায় রয়েছেÑপ্রতিটি বাড়িতে একটি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি ও তার সঠিক ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলা, স্কুল, বাস স্টেশন এবং উš§ুক্ত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পায়খানা স্থাপন করা, কমিউনিটি পায়খানা তৈরি, আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি সরবরাহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানিদূষণ নিরুৎসাহিত করা, পানির উৎসগুলো দূষণমুক্ত রাখা প্রভৃতি।
মানুষের পরিচয় প্রকাশ পায় খাবার গ্রহণ এবং স্যানিটেশনে। সুস্থতার প্রথম শর্তই হলো পরিচ্ছন্নতা। স্যানিটেশন শুধু ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং তা পরিবেশের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তাই সবার সচেতনার ফলেই সম্ভব হবে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সিস্টেম বাস্তবায়ন, যার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।
পিআইডি নিবন্ধ