স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সর্বনিম্ন ব্যয়ের সারিতে বাংলাদেশ!

ইসমাইল আলী: অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, অপর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স, হাসপাতালে শয্যা সংকট, নিম্নমানের চিকিৎসা, দক্ষ ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাবÑনানা কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাত বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছে। করোনার সময় স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা ব্যাপক আকার ধারণ ধরে। এরপরও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং গত কয়েক বছর ধরে এ খাতে বাজেট বরাদ্দ তুলনামূলক কমে আসছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তা সরকার খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।

স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বাংলাদেশের ব্যয় কম করার বিষয়টি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ‘হোয়াট হ্যাজ কভিড-১৯ টট আস অ্যাবাউট এশিয়া’স হেলথ ইমার্জেন্সি প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স?’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় মাত্র জিডিপির দুই দশমিক ৬০ শতাংশ, যা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। যদিও এ ব্যয়ের পাঁচ ভাগের চার ভাগই রোগীদের নিজেকেই বহন করতে হয়। ফলে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের দিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ৪২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম। এ তালিকায় বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে শুধু পাপুয়া নিউগিনি ও ব্রুনেই।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, স্বাস্থ্য খাতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে টুভালু। দেশটি এ খাতে জিডিপির ২১ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পালাও স্থাস্থ্য খাতে ব্যয় করে জিডিপির ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা আফগানিস্তান এ খাতে ব্যয় করছে জিডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশ। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ স্থাস্থ্য খাত ব্যয় করে জিডিপির ১৩ শতাংশ, আর্মেনিয়া ১২ দশমিক ২ শতাংশ, নাউরু ১২ শতাংশ, কিরিবাটি ও মাইক্রোনেশিয়া ১১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মালদ্বীপ ১১ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় করে। বিশ্বের উচ্চ আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ ব্যয় গড়ে জিডিপির ১৪ শতাংশ।

এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মধ্যে তৈমুর-লিস্তা স্থাস্থ্য খাতে ব্যয় করে জিডিপি ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া আট দশমিক ৪ শতাংশ, তাজিকিস্তান আট দশমিক ২ শতাংশ, জর্জিয়া সাত দশমিক ৬ শতাংশ, উজবেকিস্তান ছয় দশমিক ৭ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ছয় দশমিক ১ শতাংশ, তুর্কমেনিস্তান পাঁচ দশমিক ৭ শতাংশ ও চীন পাঁচ দশমিক ৬ শতাংশ।

এদিকে ওশেনিয়াভুক্ত দুই দেশ সামোয়া ও টোঙ্গার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির পাঁচ দশমিক ৩ শতাংশ। মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তান ব্যয়ও একই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালের ব্যয় এক্ষেত্রে পাঁচ দশমিক ২ শতাংশ ও ফিলিপাইনের ব্যয় পাঁচ দশমিক ১ শতাংশ। বাকি দেশগুলোর ব্যয় জিডিপির পাঁচ শতাংশেরও কম। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় জিডিপির সাত দশমিক ১ শতাংশ।

স্থাস্থ্য খাতে জিডিপির পাঁচ শতাংশের কম, তবে তিন শতাংশের বেশি ব্যয় করা দেশ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে রয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে মঙ্গোলিয়া ব্যয় করছে জিডিপির চার দশমিক ৯ শতাংশ, ভিয়েতনাম চার দশমিক ৭ শতাংশ, মিয়ানমার ও আজারবাইজান চার দশমিক ৬ শতাংশ, তিনটি দেশ (সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভুটান ও থাইল্যান্ড) চার দশমিক ৪ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা চার দশমিক ১ শতাংশ এবং ভানুয়াতু চার শতাংশ। এছাড়া কাজাখস্তান স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করছে জিডিপির তিন দশমিক ৮ শতাংশ, ফিজি তিন দশমিক ৭ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়া তিন দশমিক চার শতাংশ।

অন্যদিকে স্থাস্থ্য খাতে জিডিপির তিন শতাংশ ব্যয় করছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান। লাওসের এ ব্যয় দুই দশমিক ৭ শতাংশ, বাংলাদেশের দুই দশমিক ৬ শতাংশ, পাপুয়া নিউগিনির দুই দশমিক ৫ শতাংশ ও ব্রুনেইয়ের দুই দশমিক ৪ শতাংশ।

এডিবির প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে তুলনামূলক কম ব্যয় করলেও এর মধ্যে সরকারি অংশ আরও কম। বরং চিকিৎসার ব্যয়ের বড় অংশই বেসরকারি খাত তথা রোগীদের নিজেদের বহন করতে হয়। জিডিপির দুই দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে দুই দশমিক ১ শতাংশই বেসরকারি খাতকে বহন করতে হয়। আর সরকারি ব্যয় এক্ষেত্রে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ।

১৬ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের করুণ চিত্র তুলে ধরেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তাদের তথ্যমতে, গত ২০ বছর ধরে স্থাস্থ্য খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের কম। অথচ কমপক্ষে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এ খাতে জিডিপির ১ শতাংশ বা তার বেশি ব্যয় করছে। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় চতুর্থ সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের পরে রয়েছে শুধু আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ জিবুতি, বেনিন ও গাম্বিয়া।

এদিকে ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ব্যয় এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম সর্বোচ্চ। ২০২০ সালে এ খাতে গড় ব্যয়ের ৭৪ শতাংশই ছিল বেসরকারি তথা রোগীদের ব্যক্তিগত। মাত্র ২৬ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করেছে। যদিও গত দুই দশক ধরে বেসরকারি খাতের ব্যয়ের অনুপাত বাড়ছে ও সরকারি ব্যয় কমছে। তাই স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণে সরকারি ব্যয় এ খাতে বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে সিপিডি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০