পলাশ শরিফ: পিছিয়ে পড়া ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি কয়েক দশক ধরেই আলোচনায়। সরকারিভাবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত এসেছে। সেই সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য বেশকিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতির আইনি বৈধতা ও ‘হিজড়া’র সংজ্ঞা না থাকা, আইন-নীতিমালাগত জটিলতা, ‘হিজড়া’ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, উন্নয়ন কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা এবং অদূরদর্শিতার কারণে সরকারের প্রায় সব উদ্যোগই ভেস্তে যাচ্ছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির অন্তরায় খুঁজতে গিয়ে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
‘তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতির তিন বছরেও আইনি বৈধতা না থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। ওই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের মূলস্রোতে যুক্ত করতে সরকারের দেওয়া স্বীকৃতির আইনি বৈধতার বিকল্প নেই।
অনুসন্ধানে মিলেছে, ২০১৩ সালে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতির বিষয়টি আলোর মুখ দেখে। ওই বছরের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ সভায় হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপরের বছরের ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এ বিষয়ে ইশতেহারও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তিন বছরেও এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি ওই স্বীকৃতিকে আইনি বৈধতা দিতে জাতীয় সংসদেও বিল আকারে ওঠেনি। তাই ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতির প্রায় সাড়ে তিন বছরেও আইনি বৈধতা মেলেনি।
স্বীকৃতির আইনি বৈধতা না থাকা প্রসঙ্গে ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতির তিন বছরেও আইনি বৈধতা না থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। ওই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের মূলস্রোতে যুক্ত করতে সরকারের দেওয়া স্বীকৃতির আইনি বৈধতার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে গ্রহণযোগ্য একটি সংজ্ঞা ও হিজড়া বাছাই পদ্ধতিও তৈরি করা দরকার। তা না হলে সরকারের তরফে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, সেগুলো আলোর মুখ দেখবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে কাজ করতে হবে। তা না হলে সবকিছুই আইওয়াশে পরিণত হবে।’
অন্যদিকে স্বাধীনতার চার দশকেও ‘হিজড়া’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। যে কারণে ওই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে উঠছে না। এ নিয়ে জটিলতার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভায় ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ স্বীকৃতির দুই বছরের মাথায় ২০১৬ সালে ‘হিজড়া’র গ্রহণযোগ্য ‘সংজ্ঞা’ নির্ধারণ ও এ বিষয়ে জনমত গঠনের উদ্যোগ নেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এজন্য ওই জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বছরের শেষদিকে ‘সংজ্ঞা’ বিষয়ে রূপরেখা কমিশনে জমা দিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু সেই ‘সংজ্ঞা’ এখনও প্রকাশ করেনি মানবাধিকার কমিশন।
সঠিক পরিসংখ্যান, সংজ্ঞা ও বাছাই প্রক্রিয়া না থাকার কারণে কিছু জটিলতা তৈরি হচ্ছে
আলাপকালে মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) এম রবিউল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া ও তাদের জীবন-জীবিকার অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির জন্য সংজ্ঞা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা বন্ধু সংজ্ঞা চূড়ান্ত করে কমিশনে জমা দিয়েছে। শুরুতে ইংরেজি ভার্সন-ই প্রকাশ করা হবে। পরবর্তী সময়ে বাংলা ভার্সন করা হবে। তবে প্রকাশের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে, পরবর্তী কমিশন সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্বীকৃতির আইনি বৈধতা ও ‘সংজ্ঞা’ নিয়ে টানাপড়েনের কারণে ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য গত পাঁচ বছরে সরকারিভাবে নেওয়া বেশকিছু উদ্যোগ থমকে গেছে। ২০১২ সালে শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং ভাতা প্রদানের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয় সমাজসেবা অধিদফতর। কিন্তু সঠিক পরিসংখ্যান, ‘হিজড়া’ শনাক্তকরণে জটিলতা, বিতর্কিত ‘সংজ্ঞা’, অদূরদর্শী নীতিমালা ও বিদ্যমান নীতিমালাগত জটিলতার কারণে প্রকল্পটির সুফল মিলছে না।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য ও ‘সাদাকালো’ নামের একটি সংগঠনের সভানেত্রী অনন্যা বণিক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘স্বীকৃতি পেয়েছি, কিন্তু আইনি বৈধতা পাইনি। সরকারের পক্ষ থেকে অনেকগুলো পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে, চাকরি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ব্যাংকঋণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণার ঘাটতি ও বাছাইয়ের নামে বিব্রতকার পরিস্থিতি তৈরির কারণে আমরা কোনো কিছুরই সুফল পাচ্ছি না। তাই সরকারের আন্তরিকতা-পদক্ষেপকে কাজে লাগাতে হলে স্বীকৃতির গেজেট ও সংজ্ঞা নির্ধারণের ওপর জোর দিতে হবে।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্যমতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাথমিক স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী খুঁজে না পাওয়ায় উপবৃত্তির জন্য বরাদ্দ করা অর্থ ফেরত যাচ্ছে। এছাড়া হিজড়াদের বিভিন্ন বিষয়ে ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সমাজসেবা অধিদফতর। এজন্য জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা ভাতার সঙ্গে মিলছে আরও ১০ হাজার টাকা। কিন্তু পুঁজি স্বল্পতা ও প্রশিক্ষণ-পরবর্তী মনিটরিং না থাকায় প্রশিক্ষণ কাজে লাগাতে পারছে না হিজড়ারা। তারা আবারও রাস্তায় নামছে। একইভাবে জনপ্রতি ৬০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের জন্য ৫০ বছর বয়সসীমা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। একদিকে এত কম টাকায় মাসের খরচ চালানো, অন্যদিকে বয়সের শর্তের কারণে অনেকেই ভাতা পাচ্ছেন না। তাই ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত ওই কর্মসূচির পেছনে প্রায় ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও যৌন সংখ্যালঘুরা তার সুফল পাচ্ছে না।
‘স্বীকৃতি পেয়েছি, কিন্তু আইনি বৈধতা পাইনি। সরকারের পক্ষ থেকে অনেকগুলো পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে, চাকরি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ব্যাংকঋণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণার ঘাটতি ও বাছাইয়ের নামে বিব্রতকার পরিস্থিতি তৈরির কারণে আমরা কোনো কিছুরই সুফল পাচ্ছি না।
আলাপকালে সমাজসেবা অধিদফতরের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক আবদুর রাজ্জাক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা ওই জনগোষ্ঠীকে বোঝা থেকে সম্পদে পরিণত করতে কাজ করছি। তবে সঠিক পরিসংখ্যান, সংজ্ঞা ও বাছাই প্রক্রিয়া না থাকার কারণে কিছু জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া নীতিমালাগত কিছু জটিলতাও হচ্ছে। সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কর্মসূচিকে সফল করতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
এদিকে ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে ১২ জনকে বাছাই করে সমাজসেবা অধিদফতর। চূড়ান্ত ধাপে এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। ওই ১২ জনকে ‘পুরুষ’ বলে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেন চিকিৎসকরা। হিজড়া নির্ধারণ নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে হিজড়া জনগোষ্ঠীর চাকরি তথা কর্মসংস্থানের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
Add Comment