স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সংগৃহীত অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করুন

আনন্যামা নাসুহা: পথশিশুরা পৃথিবীর অদৃশ্য জনসংখ্যা, এখন পর্যন্ত সরকার প্রধানত জনশুমারি বা গৃহ জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এবং এগুলোয় সাধারণত সেসব শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যারা  পরিবারে বাস করে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক গবেষণা পদ্ধতির এই অভাবের অর্থ হলো যখন জাতিসংঘ, সরকার, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো ত্রুটিপূর্ণ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তাদের কৌশল ও নীতি তৈরি করে, তখন পথশিশুরা বাদ পড়ার ঝুঁকিতে থাকে। পথশিশুরা একটি ক্ষণস্থায়ী জীবনধারা পরিচালনা করে, যার মানে হলো তারা প্রায়ই এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ থাকে না। এর ফলে তাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ উপায়ে অধ্যয়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় শিশুরা নিজেরাই প্রাপ্তবয়স্কদের সন্দেহ করে, রাডারের নিচে থাকতে পছন্দ করে, কারণ তাদের জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকলে বৈষম্য ও প্রতিশোধের আশঙ্কা করে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাস্তার শিশুদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই, আর তাদের সংখ্যা জানাও প্রায় অসম্ভব, যা বছরে বাড়ছে। শিশুরা যত ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে, তার সবই আছে পথশিশুদের। বিশেষ করে তাদের অধিকারের জায়গা থেকে, বঞ্চনার জায়গা থেকে, সব ধরনের ঝুঁকিতে থাকা শিশুরাই পথশিশু।

পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে নিয়ে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিভিন্ন সময় পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা, দেশের বিভিন্ন জেলায় পর্যায়ক্রমে পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করা, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আলাদা আলাদাভবে বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা ও সেমিনার আয়োজন করাÑএসব সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এসব সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে অবিচল ছুটে চলেছে সারাদেশের একঝাঁক তরুণ। তাদের কাজের মাধ্যমে দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে দানের ব্যাপারে কার্পণ্য করে না। কভিডের প্রকোপকালে ফাউন্ডেশনগুলোর মাধ্যমে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেক সমাজসেবক, ব্যবসায়ী ও তারকা।

এই সরলতার সুযোগ নিয়ে কিছু সংগঠন পথশিশুদের সামনে রেখে লাখ লাখ টাকা তুলে নিচ্ছে এবং আত্মসাৎ করছে। পথশিশুদের তিন বেলা আহারের ব্যবস্থা করার ব্রত নিয়ে রাজধানীর অর্ধশতাধিক স্থানে অনুদান সংগ্রহ করছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। অনুদানের ৭৫  শতাংশ নিজেদের পকেটে নিয়ে নেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব। ছয় বছর ধরে পথশিশুদের নামে টাকা তুলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া দুই শীর্ষ পদধারীর বিরুদ্ধে রয়েছে যৌন নির্যাতন, মাদক ব্যবসাসহ ভূরি ভূরি অভিযোগ। পথশিশু ও দুস্থদের মাঝে বিনা মূল্যে খাবার বিতরণ কর্মসূচির জন্য তহবিল জোগাড়ে রাজধানীর ৫০ থেকে ৭০টি স্থানে তৎপর ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা। প্রতিদিন উত্তোলিত হয় দুই লাখের বেশি টাকা। আলো ঝলমলে কর্মকাণ্ডের পেছনে প্রথম অক্ষরের রয়েছে নিকষ কালো অন্ধকার। পথশিশুদের নামে টাকা তোলার জন্য যেসব স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে, তারা আসলে কেউ স্বেচ্ছাসেবক নয়, অর্থের বিনিময়ে চাকরি করে দানের পঁচাত্তর শতাংশ টাকাই যায় চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পকেটে। বাকি টাকা বেতন হিসেবে পান কর্মীরা। ফাউন্ডেশন ছাড়তে চাইলে কর্মীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার কথা বলে তারা টাকা তোলেন। কখনও তারা শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করার কথা বলেন, কখনও আবার ক্ষুধার্তদের মাঝে খাবার বিতরণের কথা বলে সাহায্য চান মানুষের কাছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কেউ চিকিৎসা সহায়তা পাননি বলে জানা গেছে। আবার দানের শীতবস্ত্র নিজেদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করতেন এই ফাউন্ডেশনের লোকজন। সাত বছর ধরে তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করে আসছে। পথশিশুদের ব্যবহার করে মানবিক কাজের নামে ফাউন্ডেশনের আড়ালে নির্বিঘেœ মাদক বিক্রি ও অসামাজিক কাজের অভিযোগ রয়েছে। এমন অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন আছে, যারা সাহায্য করার নামে প্রতারণা করে মানুষের সরলতার সুযোগে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে। বর্তমানের সব কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ যাচাই-বাছাই করে যেহেতু অনুদান প্রদান করা হয়, তাই সেক্ষেত্রে প্রতারনার সম্ভাবনা এখন অনেকাংশে বেড়ে গেছে। প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে যেমন সুবিধা হয়েছে, তেমনি মানবিকতার দোহাই দিয়ে অন্যকে ঠকানোর পথও উš§ুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর নেই কোনো তালিকা। তাদের কার্যক্রম বা স্বচ্ছতা সম্পর্কে নেই কোনো যাচাই-বাছাই। পথশিশুদের সংখ্যা যেমন গোপন ও অদৃশ্য, ঠিক তেমনি তাদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারেও সর্বোচ্চ উদাসীনতা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। মানবিকতার সুযোগ নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে নিজেদের পকেট ভারী করছে কতিপয় চক্র। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ ও সাধারণ জনগণের সচেতনতার মাধ্যমে আমাদের অনুদান পথশিশুদের কাছে পৌঁছাতে পারব। পাশাপাশি প্রকৃত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো স্বচ্ছতা ও কাজের প্রমাণ প্রদর্শন করে আমাদের মানবিক মূল্যবোধের সম্মান অক্ষুণœ রাখবে এবং পরবর্তী প্রজš§কে উদ্বুদ্ধ করে পথশিশুদের সুন্দর জীবন যাপনে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০