Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:41 pm

স্বেচ্ছা খেলাপি বাড়ার শঙ্কায় ব্যাংকাররা

শেখ আবু তালেব: খেলাপি হওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করতে প্রস্তাবিত নীতিমালায় ঋণের সাত শতাংশ সুদ দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে চাইছেন ১২ থেকে ১৫ বছরের। তবে বিশ্লেষক ও ব্যাংকাররা বলছেন, ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল সুবিধা নেওয়া ঋণও এখন খেলাপি হয়েছে। নতুন করে ঢালাওভাবে এ সুযোগ দেওয়া হলে বাড়তি সুবিধা আদায়ে স্বেচ্ছা খেলাপি বেড়ে যেতে পারে। তাই সবাইকে এ পুনঃতফসিল সুবিধা না দেওয়ার পক্ষে তারা।
ব্যাংকাররা বলছেন, টাক্সফোর্স গঠন করে খেলাপি হওয়াদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম খতিয়ে দেখা দরকার। তাদের সুপারিশের আলোকে অনিচ্ছকৃত খেলাপিদের (অর্থাৎ প্রকৃত ব্যবসায়িক ক্ষতিগ্রস্তরা) এ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। নইলে পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ার সরকারি উদ্যোগের কোনো ফল আসবে না। ভালো মানের ঋণ গ্রহীতারাও খারাপ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।
সূত্র জানিয়েছে, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের জন্য ক্যানসার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পরই ঘোষণা দিয়েছেন খেলাপি ঋণ আর বৃদ্ধি পাবে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের রেখে যাওয়া সুপারিশ ও ব্যবসায়ীদের দাবিতে এসব খেলাপি ঋণ পুনরায় পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে প্রস্তাব করা হয়েছে, খেলাপি হওয়া ঋণ এক বা দুই ক্ষেত্র বিশেষে কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই পুনঃতফসিল করা যাবে। ঋণের সুদহার হবে সাত শতাংশ ও মেয়াদ ১২ থেকে ১৫ বছর।
সূত্র জানিয়েছে, ঋণগুলো যখন নেওয়া হয়েছিল তখন সুদহার ছিল ১৫ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত। এখন এসব ঋণের সুদহার কমানোর দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে কার্যরত বিদেশি কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বাকি সব ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড (তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ) সাত শতাংশের ওপরে। এ সময়ে মাত্র সাত শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিল করলে অনেক ব্যাংকের লোকসান হবে। উল্টো ব্যাংকের অর্থ দিয়ে এসব ঋণ ব্যবস্থাপনা খরচ করতে হবে। এতে লোকসান কাটিয়ে উঠতে অন্যন্যা ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। খেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার বোঝা টানতে হবে ভালো গ্রাহকদের।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন খেলাপি হওয়া ঋণের অর্থের ব্যবহার নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছে, আদৌ এসব ঋণের অর্থ দেশে রয়েছে কি না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোকে দেখতে হবে যারা ঋণ নিয়েছেন তার বিপরীতে প্রয়োজনীয় জামানত রয়েছে কি না। যদি না হয়, তাহলে এই সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের বিষয়টি ঠিক করে নিতে হবে। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা ঢালাওভাবে সবাইকে দেওয়া যাবে না। যদি একান্তই দিতে হয়, তাহলে কেস-টু-কেস স্টাডি করে দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের এসব সুবিধা দেওয়া একেবারেই বন্ধ করতে হবে। নইলে তারা আবারও সুবিধা চাইবেন। সুবিধা দেওয়ার আগে তাদের শর্ত দিতে হবে অর্থ পরিশোধের। অতীতে যারা শর্ত পূরণ করতে পারেননি, তাদের এই সুবিধা দেওয়া যাবে না। তাদের আদালতে পাঠাতে হবে।
সাত শতাংশ সুদে পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাবেক এ গভর্নর বলেন, সাত শতাংশ সুদে পুনঃতফসিল সুবিধা দিলে অনেক ব্যাংকই লোকসান করবে। বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বাকিদের তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ সাত শতাংশের ওপরে, এটিও দেখতে হবে। এজন্য সুদহার নির্দিষ্ট না করে দিয়ে ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে। ব্যাংক ও গ্রাহক সমঝোতার ভিত্তিতে করতে পারে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘খেলাপি হওয়া ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহƒত হয়েছে, তা যাচাই করে দেখতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বাদ দিয়ে বাকিদের পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে, ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছকৃত খেলাপিদের শনাক্ত করার বিধিমালা করা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ বিষয়ে একটি মাস্টার সার্কুলার আছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ও খবরদারি বৃদ্ধি করে দেখতে হবে ঋণ বিতরণ যথাযথ নিয়ম মেনে দেওয়া হয়েছে কি না। নইলে এসব ঋণ পুনরায় খেলাপি হয়ে যাবে। সাত শতাংশ সুদের দাবি মেনে নিলে ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড উঠবে না, এতে লোকসান হবে ব্যাংকের। লোকসানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে নতুন ঋণগ্রহীতাদের ওপর। এতে ঋণ সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।
ব্যবসায়ীদের এসব সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি আইনি সংস্কার ও আইন প্রয়োগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য বিচার বিভাগীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি করার ওপরও জোর দেন তিনি।
অবশ্য ব্যবসায়ীদের এমন ঢালাও সুবিধা দিলে দুর্নীতিকে উসকে দেওয়া হবে বলে মনে করেন ভালো ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী জানান, অনিয়ম ও যোগসাজশের মাধ্যমে দেওয়া ঋণই বেশি খেলাপি হয়। এসব ঋণ পুনঃতফসিল করে ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই ঋণ পুনঃতফসিল করলে এক শ্রেণির ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের লাভ হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে চায় তাহলে তৃতীয় কোনো পক্ষ বা টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে। তারা খেলাপি হওয়া ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে সুপারিশ করবে। এরপর ব্যাংক চাইলে সুবিধা দেবে, নইলে আদালতে মামলা করবে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনও আদালতে জমা দেওয়া যেতে পারে। খেলাপিদের বিচার করতে আদালতের সংখ্যাও বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে আইনি সংস্কারও লাগবে। এজন্য শুধু খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল করলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমবে না। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। যার আলোকে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পারে। নইলে উদ্যোগ কাজে আসবে না।
অবশ্য এ বিষয়ে ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হলে ব্যাংকেরও লাভ হয়। কিন্তু আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভালো গ্রাহক, যাতে ডি-মোটিভ্যাটেড হয়ে না যায়। এজন্য সুবিধা দেওয়ার বিষয়গুলো পুরো স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। এটি নিয়ে যেন কোনো বিতর্ক তৈরি না হয়।
প্রসঙ্গত, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি হওয়া ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এর বাইরে খেলাপি হওয়া ঋণ অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এ দুটি তথ্য যোগ করলে আনুষ্ঠানিক হিসাবেই খেলাপি হওয়া ঋণের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় এক লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
এটি খেলাপি ঋণের প্রকৃত হিসাব নয়। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ঋণখেলাপি হলেও তা দেখানো হয় না। এছাড়া খেলাপি হওয়া ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে গত বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকারও ওপরে। এসব বিবেচনায় নিলে দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরও ২০১৫ সালে ব্যবসায়ী গ্রুপের যাদের ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি পরিমাণের খেলাপি রয়েছে, তাদের ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। এভাবে ১১টি ব্যবসায়িক গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এসব ঋণও এখন খেলাপি।