স্বৈরাচারের পতন, তারুণ্যের জয়

রুহুল আমিন: তরুণ প্রজš§ ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ দেখেনিÑচব্বিশ সালে দেখেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। তারা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরকে দেখেনি, দেখেছে আবু সাঈদ ও মুগ্ধসহ চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আত্মোৎসর্গকারী নানা বয়সী শত শত মানুষের শাহাদাতবরণ। নতুন প্রজš§ একাত্তর সালের আগে পাকিস্তানের জুলুম দেখেনি, দেখেছে স্বৈরাচারী শাসকের একনায়কতন্ত্র, মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার, গুম ও খুন। অবৈধভাবে নেতা এবং সরকারি আমলাদের টাকার পাহাড়। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার। কানাডায় বেগমপাড়ায় সরকারি কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি। বেনজীরের নজিরবিহীন দুর্নীতি, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের ছাগল কাণ্ডসহ কত অনিয়ম। দেখেনি পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা, দেখেছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল ছাত্ররা। এর সূত্রপাত ঘটেছিল ২০১৮ সালে তখন প্রধানমন্ত্রী যৌক্তিক সংস্কার না করে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন। যেটি ছাত্রদের চাওয়া ছিল না। গত ৫ জুন হাইকোর্ট সরকারের জারিকৃত ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে। ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্ররা ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেয়। ছাত্রদের দাবি না মানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে আসে। এবারের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, কোটা বাদ দেয়ায় অনেক জেলায় অনেক বেশি ক্যাডার হয়েছে আবার অন্য অনেক জেলায় কোনো ক্যাডারই নেই, নারী ক্যাডারের সংখ্যা কমে গেছে, নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে গেছে।

এ বিষয়ে সবাই একমত, এতে সুষম বণ্টন করা যায়নি। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত তো এককভাবে প্রধানমন্ত্রীই নিয়েছেন। এটা তো কারও দাবি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘আমি রাগ করে বাদ দিয়ে দিয়েছি।’ তার মনের কথাটা ব্যক্তিগত অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বলে ফেলতেই পারেন কিন্তু সংবাদ সম্মেলন করে বলতে পারেন না। অথচ তিনি শপথ নেয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের আবেগ, রাগের বশীভূত হয়ে এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ৬ জুলাই থেকে শুরু হয় বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি। সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধ করে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে। বাংলা ব্লকেডের দ্বিতীয় দিনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রেখে সংসদে আইন পাসের একদফা দাবি করেন। হাইকোর্টে রায় চার সপ্তাহ স্থগিত রেখে আপিল বিভাগ রায় দেন। এটিকে সরকারের কৌশল বলে আখ্যা দেন ছাত্ররা। এরপর আন্দোলন থামাতে না পেরে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা এবং আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হলো।

গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ এমন মন্তব্যের প্রতিবাদে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ‘রাজাকার’ সেøাগান। এর জবাব হিসাবে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়া হলো সাধারণ ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় হয়ে উঠল রণক্ষেত্র। প্রতিটি হল হয়ে উঠল রণক্ষেত্র। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে বিভিন্ন জায়গায় থেকে টোকাই ভাড়া করে এনে ছাত্রদের ওপর হামলা করা হলো। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সরাসরি গুলিতে আবু সাঈদকে হত্যা করে আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন। ঢাকায় গুলি চালিয়ে শত শত ছাত্র জনতার বুক ঝাঁজরা করে দিলেন।
ছাত্ররা যে দাবিতে আন্দোলন করেছিল মেনে নিলেন এবং তারা যে প্রক্রিয়ায় চেয়েছিল সেভাবেই। তখনই মানলেন যখন আর দাবি-দাওয়া আর কোটায় সীমাবদ্ধ নেই।
একদিকে বলা হলো সরকার ও ছাত্রদের চাওয়ায় কোনো অমিল নেই; তবে সিদ্ধান্ত আসবে কোর্টে, সরকারই আপিল করবে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত থাকলেই চলত কিন্তু কোটা আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা নেতিবাচক তথা উস্কানিমূলক মন্তব্য করে যেতে থাকলেন। আন্দোলনকারীরা সরকারের কোটা সংস্কারের সদিচ্ছাকে সন্দেহ করল, অবিশ্বাস করল এবং আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকল। আন্দোলন শাহবাগ পেরিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল। সরকার যথারীতি ছাত্রদের ক্ষমতাকে পাত্তা দিল না। প্রথমে আন্দোলন সাধারণ ছাত্ররাই করেছে এবং তার যৌক্তিকতাও ছিল। যখন এমন একটা আন্দোলনের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকার তখন বিএনপি জামায়াতের লোকজন যে এতে অংশ নেবে; এটাই স্বাভাবিক। তারা দিনের পর দিন আলটিমেটাম দিয়েও একটা সফল আন্দোলন করতে পারেনি, কারণ তাদের কাছে জনগণের সমর্থন নেই।

বিক্ষুব্ধরা আওয়ামী লীগ সরকারকে পছন্দ করেন না এর মানে এই নয় যে, তারা জামায়াত বিএনপিকে পছন্দ করে। তাই অন্যের আন্দোলনে শরিক হওয়া ছাড়া তাদের বিশেষ পথ ও নেই। ভুলটা এখানেই করলেন। একটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে সরকারি পক্ষ ‘জামায়াত বিএনপির ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি বললেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন। আন্দোলনকারীরা তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ল। আন্দোলনকারীদের আত্মসম্মান বোধে আঘাত হানলেন। এ প্রজšে§র আত্মসম্মানবোধ খুবই শক্ত।
বিএনপি জামায়াতকে ১৫ বছর ধরে যে কায়দায় প্রতিহত করেছেন। সেই কায়দায় ছাত্রদের প্রতিহত করতে চাইলেন। আন্দোলনকারী সমন্বয়কারীদের গুম আটক করে নির্যাতন করলেন। আন্দোলনে হতাহত ছাত্রদের খোঁজ খবর না নিয়ে সরকার দালান কোটার শোকে মায়া কান্নায় ভেঙে পড়ল। মানুষের জীবনের চেয়ে আপনাদের দালান কোটা বড় হয়ে গেল। সারাদেশে গণগ্রেপ্তার এবং ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে নিরাপত্তার অজুহাতে আটকিয়ে রাখলেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের লিখিত ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু ছাত্ররা সে ফাঁদে পা দেয়নি।

সরকার লোক দেখানো শোক পালন করার ঘোষণা দিল কিন্তু ছাত্ররা সেই শোককে প্রত্যাখ্যান করে সবাই লাল কাপড় মুখে-চোখে বেঁধে এবং ফেসবুক প্রোফাইল পরিবর্তন করে প্রচার করতে লাগল।
জনগণকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখতে জামায়ত-শিবিরকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেন। ছয় সমন্বয়ক ৩২ ঘণ্টা অনশন করার পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছেড়ে দিলেন। তারা ৯ দফা দাবি নিয়ে কর্মসূচি করতে থাকলে তাতেও গুলি চালিয়ে নির্বাচারে মানুষ মারলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে অসহযোগ আন্দোলন এবং এর রূপরেখা ঘোষণা করেন।

অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি সব পেশাজীবী মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্নভাবে অপব্যবহার করে ফায়দা লুটিয়েছেন। মানুষের কাছে দুটি জিনিসের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেললেন। মানুষ তার ভোট দেয়ার গণতান্ত্রিক হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশে কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছে। আওয়ামী লীগের টিকিট পেলেই যেন জয় চূড়ান্ত। জনপ্রতিনিধিরা এখন জনগণের কথা ভাবেন না। তারা টাকার কথা ভাবেন। কীভাবে দলের ওপরের মহলকে টাকা খাইয়ে নৌকার টিকিট পাওয়া যাবে, সেটির কথা চিন্তা করেন। দলীয় টিকিট পেলে দলীয় ক্যাডার এবং প্রশাসনের দ্বারা বিজয় নিশ্চিত। এ কারণে তারা জনগণের কাছে থেকে দূরে সরে গেছে। মানুষ বাকস্বাধীনতা হারিয়েছে। মানুষ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লেও তাদের জীবনযাত্রার মান কমিয়েছে। কারণ দুর্নীতি করে কেউ সম্পদের পাহাড় গড়েছে; বিপরীতে অনেকের মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়েছে দুর্নীতিবাজদের জন্য। বিপরীত পক্ষকে দমনপীড়ন নীতি।

নেতাদের সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে সম্পদের পাহাড়। এসবে কারণে মানুষ কথা বলার সাহস পায়নি। তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথে নেমে পড়ে। ছাত্রদের সঙ্গে গণমানুষের অংশগ্রহণে টিকতে না পেরে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। ছাত্রসমাজকে সুন্দর আগামী গড়ার জন্য কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো দল যেন একনায়কতন্ত্র বানিয়ে দেশকে ধ্বংস না করে সেদিকে সব নাগরিককে খেয়াল রাখতে হবে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। দেশের মানুষ যেন বাকস্বাধীনতা না হারায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে। মেধার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। দেশের গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাজনীতি দূর করতে হবে। সব নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল যেন হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ না পায় সেদিকে প্রশাসনের খেয়াল রাখতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত দেশ গঠন করতে হবে। দেশের সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে সোনার বাংলায় রূপ সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০