নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত হয়েছে, কিন্তু এতেই সব শেষ নয়। এটা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের একটা মাধ্যম বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘বাকস্বাধীনতা খর্ব করে দেশকে সার্ভেইলেন্স বেইজড সোসাইটি বা নজরদারিভিত্তিক সমাজে পরিণত করা হয়েছিল। স্বৈরশাসকরা ভেবেছিলেন তারা অপরাজেয়, কিন্তু তরুণ প্রজš§ যে তার চেয়েও বেশি অপরাজেয়; এটি তারা ভুলে গেছেন।’
বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে গতকাল রোববার ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন: তরুণদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেনÑবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবু বাকের মজুমদার, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, সদস্য আরিফুল ইসলাম আদীবসহ তরুণ পেশাজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষার্থীরা। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এটা আরেকবার প্রমাণ হয়েছে। যে কারণে পদদলিত হতে হয়েছে স্বৈরাচারকে।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। কিন্তু অভীষ্টের বিবেচনায় মূল লক্ষ্য নতুন বাংলাদেশ। রাষ্ট্র? সংস্কারের কথা আমাদের তরুণ প্রজš§ বলছেন। বর্তমান ও আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাদের কাছে যে চেতনা নতুন করে প্রস্ফুটিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে প্রভুত্ববাদ অবসান, সহনশীলতা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।’
আর্থসামাজিক খাতে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এতেই সব শেষ নয়, স্বৈরাচারের পতন ছিল একটা মাধ্যম। নতুন জায়গায় যাওয়ার একটা মাধ্যম। সেই নতুন জায়গাটা হলো আমাদের নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কার ও রাজনৈতিক সমঝোতা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে, সেগুলোকে কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই চর্চায় ত্রিমুখী আঁতাত কাজ করেছে। রাজনৈতিক শক্তি একদিক থেকে, আমলাতন্ত্র আরেকদিক থেকে। অন্যদিক থেকে বিনিয়োগকারীরা কাজ করেছেন। দুর্নীতি সহায়ক ও দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেয়ার মতো রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। সেটাকে ধারণ করার জন্য আমাদের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।’
অনুষ্ঠানে সমন্বয়কদের সহযোগিতা করার অনুরোধ জানিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সবার আন্দোলন ছিল। পরবর্তী সময়ে এটাকে সর্বজনীন করতে হলেও আমাকে সবার কাছে যেতে হবে। তোষামোদী করা কি অপরাধ কি নাÑএটা জানতে চাই? এটা কি অপরাধ? এটা অপরাধ না। আমি যদি কারও সমালোচনা করতে পারি, আমি শর্তহীন প্রশংসাও করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড়ে কেউ আমার নাম বেচে লাখ টাকা নিয়ে আসে, সেটায় আমি প্রতিবাদ জানাতে পারি। এটার জন্য সবাইকে অসম্মান করলে আমাদের কাজের পরিধি কমে যায়। আমরা ডিমোরালাইজড হই। আমরা ত্রাণ তুলি সেটাতে সমস্যা, শহিদদের স্মরণে অনুষ্ঠান করি সেটাতেও সমস্যা।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ সমন্বয়ক বলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, রাতে ঘুমানোর আগে যাই একটু সমন্বয়কদের গালাগালি করে আসি। কমেন্টসে গালাগালি করে আসি। কারণ এটা সবচেয়ে সেফ জোন। আমরা ভলান্টিয়ার বেসিসে কাজ করছি, আমরা অথরিটি না। আমরা সবার সহযোগিতা চাই। আমরা অথরিটি না, লিগ্যাল এনটিটি নই। মানুষ ডিভোর্সের সমস্যা থেকে শুরু করে সচিব পদবি চেঞ্জ করার জন্য (আমাদের কাছে) আসেন। কিন্তু আমাদের অথরিটি নাই। যদি আমাদের কোনো ভুল থাকে সেটা কীভাবে সংশোধন করব, সেটা কীভাবে অ্যাড্রেস করবÑসে বিষয়ে প্রপার সলভ করেন। এটা হলে আমাদের জন্য কাজ করা সহজ হয়।’
তরুণরা সুশীল সমাজের পরামর্শ চায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একটা রিয়েলস্টিক এটিটিউড তৈরি হয়েছে, এটার দায়ভার সুশীল সমাজ এড়াতে পারে না। বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭১, ২০২৪-এ ফেইল মারছেন। আমাদের ক্ষমতা বিমুখতা বা আমরা কেন ভয় পাইÑএ দায়ভার সুশীল সমাজকে নিতে হবে। ২০২৪ যদি ৯০-এর পুনরাবৃত্তি হয়, একাত্তরের পুনরাবৃত্তি হয়, ৫২’র পুনরাবৃত্তি হয় তাহলে আমাদের যে শক্তি বা সামর্থ্যরে জায়গা তৈরি হয়েছে সেটা আর কখনোই পুনরায় মঞ্চায়ন সম্ভব হবে না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আরিফ সোহেল বলেন, ‘জনগণের ভাষা যেটা লড়াই ও প্রতিরোধের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে সেটাকে আমরা ক্ষমতায় আসতে দেখিনি। আমাদের রাজনৈতিক দল থেকে পরিবারতন্ত্র সরাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। এই আকাক্সক্ষার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি রূপান্তর করতে হবে। এই রূপান্তর কোনো মাইনাস প্রক্রিয়া না। গণ-অভ্যুত্থানে যে স্পিরিট তৈরি হয়েছে সেটি দেখে থাকলে, অনুধাবন করতে পারলে দলগুলোয় রূপান্তর ঘটবে। আমরা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোয় রূপান্তর দেখতে চাই। আমরা এই বোঝাপড়া করতে চাই, সবার সঙ্গে বসতে চাই।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা কী ছিল সেই আলাপ আমরা শুনতে চাই। এরপর আগামী বাংলাদেশের রূপরেখা আমরা সাজাতে চাই।’
কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন বলেন, ‘শিল্প-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। শুভ বোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে হবে।’