মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে মাগুরার শালিখা উপজেলার শরুশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৩ বছর ৬ মাস বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এরপর কিছুদিন চাচার তত্ত্বাবধানে, পরে যশোরের মিছরিদিয়াড়া গ্রামের এক বিধবার বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে ঝিকরগাছা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৪৫ সালে যশোর মধুসূদন কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রথমে কলকাতায়, পরে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঢাকায় কাজ করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেছে এই রকম একটি সংবাদ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম করার জন্য সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁ রেগে যান। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট অফিস থেকে যুক্তফ্রন্ট না ভাঙার বিষয়টি জানিয়ে একটি বিবৃতি পাঠানোয় সিরাজুদ্দীন হোসেন দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ভিত্তিতে সংবাদটি ছাপেন। মওলানা আকরম খাঁর নির্দেশ অমান্য করায় পরদিনই মওলানা আকরম খাঁ সিরাজুদ্দীন হোসেনকে চাকরিচ্যুত করেন। ১৯৫৪ সালে ‘আজাদ’-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার এক বছর পর তিনি ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালে ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে গেলে তিনি সংবাদ প্রতিষ্ঠান পিপিআই’র ব্যুরো চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করলে তিনি এই আন্দোলন ও পরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। শিশু অপহরণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি সম্পর্কে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ইত্তেফাকে দুঃসাহসিক সম্পাদকীয় লিখতেন। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়মিতভাবে মুজিবনগর সরকারের কাছে পাঠাতেন। ১৯৭০ সালে তিনি ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় দিন আগে ১৯৭১ সালে ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে চামেলীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি ১৯৭৬ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।
কাজী সালমা সুলতানা