উপমহাদেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী, নৃত্যগুরু, লেখক বুলবুল চোধুরী। নৃত্যশিল্পকে জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে রক্ষণশীল সমাজে নৃত্যকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি এক অনন্য পথিকৃৎ। বুলবুল চৌধুরী ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনতি গ্রামে। তার পুরো নাম রশীদ আহমদ চৌধুরী আর ডাকনাম টুনু। ছেলেবেলা থেকে নাচ, গান, ছবি আঁকা এবং গল্প-কবিতা লেখার প্রতি বুলবুলের প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি মানিকগঞ্জ জিলা স্কুল থেকে চার বিষয়ে লেটার মার্কসসহ ম্যাট্রিকুলেশন (১৯৩৪), প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৩৬), স্কটিশ চার্চ কলেজে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর (১৯৪০) ডিগ্রি লাভ করেন। বুলবুল চৌধুরী স্নাতকোত্তর শেষে অফিসার হিসেবে যোগ দেন টাটা এয়ারক্রাফটে। পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এলে তিনি মন দেন নৃত্যের নতুন নতুন কম্পোজিশনে। মানিকগঞ্জ হাইস্কুলের এক বিচিত্রানুষ্ঠানে স্বরচিত ‘চাতক-নৃত্য’ পরিবেশনের মাধ্যমে তার নৃত্যশিল্পী জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৩৭ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন ওরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বুলবুল তার নাচের দল নিয়ে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন ১৯৪৯ সালে। এ সফরের পর নৃত্যচর্চাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এমনকি ভারতীয় নাগরিকত্ব ছেড়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সরকার তাকে জাতীয় শিল্পী ঘোষণা করে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৭০টি নৃত্যনাট্য রচনা এবং পরিবেশন করেন। নৃত্য ছাড়াও তিনি লেখার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। তার প্রথম নিবন্ধ ছাপা হয় হবীবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত বুলবুল পত্রিকায়, ১৯৩৪ সালে। অজয় কুমার ছদ্মনামে তার বেশ কিছু কবিতা বুলবুল পত্রিকায় ছাপা হয়। তার রচিত চারটি গল্প‘অনির্বাণ’, ‘পয়মাল’, ‘আগুন’ ও ‘রক্তের দাগ’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে প্রাচী (১৯৪২) নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন তিনি। নাচের দল নিয়ে তিনি ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেন। তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৫৯ সালে প্রাইড অব পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৪ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নৃত্যশিল্পে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫৫ সালের ১৭ মে ঢাকায় তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ললিতকলা একাডেমি।
কাজী সালমা সুলতানা