বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়োরোস্তামি ১৯৪০ সালের ২২ জুন ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন। আব্বাস কিয়োরোস্তামি যে ছবি আঁকেন ও ছবি তোলেন, তা বোঝা যায় তার নির্মিত সিনেমার চিত্রগ্রহণে নজর দিলে। এ সম্পর্কে আব্বাস কিয়োরোস্তামির মতামতটা এরকম: …আমার তো মনে হয় না চিত্রকলা, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্রÑ এসবের কোনোটাই আলাদা কিছু, বরং বলা যায় এসবই একসূত্রে গাঁথা। আমি বাস্তবতাকে শৈল্পিকভাবে দেখতে অভ্যস্ত, বিশেষ করে তা চিত্রকলার অবস্থান থেকে। আমি প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য বা ভূচিত্রকে চিত্রকলার ফ্রেমের মধ্যেই দেখি। আমি সব কিছুই নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করি। এমনকি আমি যখন গাড়িতে থেকে বাইরের দিকে তাকাই তখনও বাইরের দৃশ্যাবলিকে সেই ফ্রেমের মধ্য দিয়ে দেখি। চলচ্চিত্রে এভাবেই আমি বাস্তবতাকে ধারণ করি।
ইরানি চলচ্চিত্রে নির্মাতারা নানারকম বিধিনিষেধ ও অনুশাসনের মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আব্বাস কিয়োরোস্তামি জানান, … বিশ্বের অন্যসব দেশের তুলনায় ইরানি চলচ্চিত্র স্বতন্ত্র। এর কারণ শুধু এর বিষয়বস্তু বা স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নয়। এর মূল কারণÑ ইরানের চলচ্চিত্রে নির্মাতারা যা দেখাতে চান, এর জন্য তাদের অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে যেতে হয়। … জীবনটাই হচ্ছে বিধিনিষেধ আর স্বাধীনতার সমন্বয়। আমি বলছি না এ বিধিনিষেধ চলচ্চিত্রশিল্পে থাকা ভালো বা এর প্রয়োজন আছে। এ বিধিনিষেধ শুধু আমার কাজেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা নয়; বরং প্রত্যেকের কাজেই করে। তবে এ প্রতিবন্ধকতা অনেক সময় সৃজনশীল মানুষকে আরও বেশি সৃজনশীল করে তোলে। ইরানে অনেকের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। …
আব্বাস কিয়োরোস্তামি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন অভিনয় না-জানা লোকদের নিয়ে। তার এ সম্পর্কিত মতামতটি হচ্ছেÑ অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করার একটা বড় সুবিধা হলো তারা আমার স্ক্রিপ্ট ঠিক করে দেয়। আমি যা লিখি তা যদি একজন অপেশাদার অভিনেতা ঠিকভাবে মুখে আনতে না পারে, তাহলে আমি ধরে নিই, আমি ঠিকভাবে লিখতে পারিনি। … সাধারণত চলচ্চিত্র নির্মাতারা তারকা শিল্পীদের দিয়ে একজন সাধারণ লোকের ভূমিকায় অভিনয় করান, আমি সাধারণ লোককে তার নিজের ভূমিকায় অভিনয় করতে বলি। ফলে অপেশাদার শিল্পীরা যখন নিজের ভূমিকায় অভিনয় করে, সে অভিনয় অনেক বেশি বাস্তব হয়। …
ঊনাশির বিপ্লবের পর সেন্সর বোর্ডের বাড়াবাড়ির কারণে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাই দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু আব্বাস কিয়োরোস্তামি তা করেননি। এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আব্বাস কিয়োরোস্তামি বলেন, ‘একটি গাছ এক জায়গা থেকে তুলে নিয়ে অন্যত্র রোপণ করা হলে তা আর আগের মতো ফলবান থাকে না। কিছু ফল যদি দেয়ও, তার মান আগের মতো থাকে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমার ধারণা দেশ ত্যাগ করলে আমি সেই নির্জীব বৃক্ষের মতোই হয়ে যাবো।’
আব্বাস কিয়োরোস্তামি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রসহ প্রায় ৪০টির মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তিনি প্রায় ২৫টি পুরস্কার জয় করেছেন এবং অনেক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে অর্জন করেছেন ফেলোশিপ। কানসহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে জুড়ি বোর্ডের সদস্য ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
আব্বাস কিয়োরোস্তামি ২০১৬ সালের ৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।