সুচিত্রা মিত্র ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার হাতিবাগানে জন্ম গ্রহণ করেন। একেবারে কৈশোরে তার শিল্পী জীবনের শুরু। ১৯৪৫-এ প্রথম তার গানের রেকর্ড বেরোয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। সেটা রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড এক পিঠে ‘মরণেরে তুঁ হু মম শ্যাম সমান’, অন্য পিঠে ‘হৃদয়ের একুল-ওকুল দু’কুল ভেসে যায়’। দ্বিতীয় রেকর্ডটি তার পিতার লেখা গান এক পিঠে ‘তোমার আমার ক্ষণেক দেখা’, অন্য পিঠে ‘আমায় দোলা দিয়ে যায়’। এরপর মৃত্যু অবধি তার সাড়ে চারশ’রও বেশি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র সম্পর্কে প্রয়াত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গানে সেরা হচ্ছে সুচিত্রা… সে বেশ গলা ছেড়ে পুরো দমে গায়। এর মধ্যে কোনো গোঁজামিল নেই… তার সাবলীলতা… সে এক দেখার এবং শোনার জিনিস। তার ছন্দজ্ঞানও অসামান্য… সুচিত্রা নিখুঁত। মনে হয় দিনেন্দ্রনাথ বুঝি ফিরে এলেন।’
বেশ কিছু চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক গায়ক হিসেবেও গান গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আর সংগীতের প্রতি আশৈশব ভালোবাসা আর তীব্র টানে তিনি পুরোপুরি নিজেকে উৎসর্গ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হন। তার গায়কী ঢং ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র প্রকৃতির। তার কণ্ঠ মাধুর্যের সঙ্গে ছিল এক ধরনের দৃঢ়তা । রবীন্দ্রসংগীতে তার উচ্চারণ, স্বরক্ষেপণ, তার কণ্ঠ আদর্শ হয়ে উঠেছিল। গান প্রাণ পেত তার কণ্ঠে। রবীন্দ্রসংগীতের তুলনারহিত প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন তিনি অগণিত শ্রোতাদের কাছে। রবীন্দ্রসংগীত ছাড়াও তার গলায় প্রাণ পেয়েছে অতুলপ্রসাদের গান, ব্রহ্মসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও হিন্দি ভজন।
শান্তিনিকেতনে তিনি নানা বাদ্যযন্ত্র শিখেছেন সেতার, এস্রাজ, তবলা। এ সময় সহপাঠী ছিলেন নীলিমা সেন। তিনি ধ্রুপদী সংগীত শিখেছেন ভি ভি ওয়াঝেলকরের কাছে। এ সময় কিছুদিন, প্রায় দুবছর নাচ শেখার চেষ্টাও করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ভালোবাসতেন। তাই যখন রবীন্দ্রসংগীতের সেরা শিল্পীর তকমা জুটে গেছে, সে সময়, পরিণত বয়সে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘দহন’ নামক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে নির্মিত উমাপ্রসাদ মৈত্রের জয় বাংলা এবং মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’-এ অভিনয় করেছেন। এছাড়া বিষ্ণু পাল চৌধুরীর টেলিফিল্ম ‘আমার নাম বকুল’-এর একটি পর্বে তিনি অভিনয় করেন। দীর্ঘদিন তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪১ সালে বৃত্তি নিয়ে গান শেখার জন্য শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকে অভিনয় করেছেন। পরবর্তী সময়ে যেসব নাটকে অভিনয় করেছেন সেগুলো হলো মুক্তধারা, বিসর্জন, তপতী, নটীর পুজা, মায়ার খেলা, চিরকুমার সভা ও নীলদর্পণ।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সংগীত নাটক আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি; এছাড়া এইচএমভি গোল্ডেন ডিস্ক অ্যাওয়ার্ড, বিশ্বভারতী থেকে দেশিকোত্তম ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে আলাউদ্দিন পুরস্কার লাভ করেছেন। আরো পেয়েছেন সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারসহ নানা সম্মান। সাম্মানিক ডি-লিট পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তিনি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ছোটদের জন্য লিখেছেন কবিতা ও গল্প; লিখেছেন স্মৃতিকথা। তিনি কহলিল জিবরানের কবিতার অনুবাদ করেছেন। সুচিত্রা মিত্র আবৃত্তি করতে ভালোবাসতেন। ছবি আঁকা ছিল তার আরেকটি নেশা। ছবির প্রদর্শনী পর্যন্ত তিনি করেছেন। কর্মযোগী সুচিত্রা মিত্র ১৯৪৬ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রসংগীতের স্কুল রবিতীর্থ স্থাপন করেন। ভারতে এটি রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার অগ্রগণ্য বিদ্যাপীঠ হিসাবে পরিগণিত। স্কুলের নামটি অধ্যাপক কালিদাস নাগ কর্তৃক প্রদত্ত। রবিতীর্থের তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। রবিতীর্থের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি বহুদেশে নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেছেন। ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি ভারতের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Add Comment