আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভ‚ঞা: প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের বসবাস। এই প্রকৃতি মানুষকে বাঁচার পরিবেশ দিয়েছে এবং খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। মানুষ তার জীবন-জীবিকা নির্বাহের সব উপকরণ প্রকৃতি থেকেই পেয়ে থাকে। কিন্তু তারপরও মানুষ কখনোই পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে তেমন ভালো আচরণ করছে না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাণ-প্রকৃতির ওপর। পরিবেশের সঙ্গে জলবায়ুর সম্পর্ক অতিনিবিড়। জলবায়ু বিপর্যয় শুধু একটি পরিবেশগত বিষয় নয়; এটি একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং উন্নয়নমূলক বিষয়, যা আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮৪ সালে ভ‚পালে ইউনিয়ন কার্বাইড কীটনাশক তৈরির কারখানা থেকে মিথাইল আইসোসোয়ানেট বের হয়ে কয়েক সহস াধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৮৬ সালে চেরেনোবিল দুর্ঘটনায় সেখানকার ১৪ হাজার বসতির ৪ হাজার মানুষ তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। এই দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলার। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার কারণে পরিবেশে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব বৃদ্ধি জলবায়ু বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। জলবায়ু বিপর্যয়ে বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাবের ফলে দেশে দেশে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে।
জলবায়ু বিপর্যয় প্রশ্নে পৃথিবীজুড়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার গত কয়েক বছরে নতুন প্রাণ পেয়েছে। তা সত্তে¡ও ২০২৩ সালে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ফলে বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৪০ গিগাটন ছাড়িয়ে গেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বৈশ্বিক জ্বালানি খাতবিষয়ক সংস্থা এনার্জি ইনস্টিটিউট। তবে গেøাবাল এনার্জি রিপোর্ট বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী বায়ু ও সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন ১৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৭৪৮ টেরাওয়াট ঘণ্টায় পৌঁছে। সা¤প্রতিক এনার্জি ইনস্টিটিউট প্রতিবেদন বলছে, গত এক বছরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ৫০৫ এক্সাজুলে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী গ্যাসের চাহিদা স্থির রয়েছে। কিন্তু কয়লার চাহিদা ১ দশমিক ৬ শতাংশ ও জ্বালানি তেলের চাহিদা ২ শতাংশ বেড়ে প্রথমবারের মতো দৈনিক ১০ কোটি ব্যারেলে উন্নীত হয়েছে। তাই প্রতিবেদন বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক অর্থনীতির স¤প্রসারণ এখনই থামবে কিনা অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ অঞ্চল ভেদে জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতা ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণে বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।
পৃথিবীর সব শক্তির রূপান্তর ঘটছে। এই রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে সৌর, বায়ু ও পানিবাহী শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তি রয়েছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস যেমনÑসৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, সমুদ্রতরঙ্গ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রচলিত বিদ্যুৎ সরবরাহবিহীন জায়গাগুলোতে জনসাধারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। নবায়নযোগ্য শক্তির বড় সুবিধা হলো, এটি পরিবেশবান্ধব। এরা বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে না। বায়ুপ্রবাহ ও সৌরশক্তি অফুরন্ত। ফলে নবায়নযোগ্য শক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য শক্তি খুব সহজেই পাওয়া যায়। তাই জাতিসংঘের জলবায়ু-বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে ‘কপ২৮’-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর আহŸান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৯৭ শতাংশের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকুচিত করছে। ইতোমধ্যে-ই ক্যাপাসিটি চার্জ বিদ্যুৎ খাতে গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র আরও বাড়ানো হলে তা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলবে। আমদানি-নির্ভর নতুন জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক (গ্যাস, কয়লা, জ্বালানি তেল) বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার ঝুঁকি আরও বাড়াবে বলে বলছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বøুমবার্গএনইএফ।
উন্নয়নের নামে অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি জলবায়ুকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে গেছে। আগে ধারণা করা হতো, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির তেমন সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে, বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাবনা কম। কিন্তু স¤প্রতি মার্কিন জাতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি পরীক্ষাগার পরিচালিত মূল্যায়ন থেকে জানা যায়- বাংলাদেশের বায়ুবিদ্যুৎ সম্ভাবনা অতীতের অনুমিত পরিমাণ থেকে বেশি। দেশের উপক‚লীয় বিশাল অঞ্চলগুলো এ জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশে বায়ুর সর্বোচ্চ গতিবেগ ৭.৭৫ মিলি/সেকেন্ড, যা দিয়ে ৩০ গিগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, দেশের মোট জমির ৪ শতাংশ ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব। এছাড়াও নদীর অবিচ্ছিন্ন ধারা ও জলপ্রপাত (রান অব দ্য রিভার) বা জলাধার সৃষ্টি এই দুই প্রক্রিয়ায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। আমাদের দেশে রান অব দ্য রিভার ও জলপ্রপাত ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা সীমিত। আবার পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব, জটিল ও ব্যয়বহুল পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার কারণে নদীতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাইয়ের মতো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব নয়। তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদী ছোট ছোট সিজনাল হাইড্রো ও ঝরনা (ক্ষুদ্র জলপ্রপাত) ব্যবহার করে ক্ষুদ্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ আছে। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় সীমিত পরিমাণে ভ‚-তাপীয় (জিও থার্মাল) জ্বালানি সম্ভাবনা আছে। ধারণা করা হয়, বায়োমাস থেকে বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ মেটানো হয়ে থাকে। বায়োমাস ও বর্জ্য ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানি গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে।
যদিও ১৯৫৭ সালে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর মধ্য দিয়ে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার শুরু হয়। এ কেন্দ্রটির সক্ষমতা বাড়ানো হয় ১৯৮৮ সালে। এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হয় সোলার হোম সিস্টেম বসানোর প্রকল্প। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ-সুবিধা পৌঁছায়নি, সেসব এলাকার ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ যন্ত্র বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম বসানো হয়েছে বলে দাবি করছে, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রে ডা)।
কয়লা, তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের সঙ্গে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছে বøুমবার্গ। ‘সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাঁকে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত’ শিরোনাম প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌরবিদ্যুতের প্রযুক্তি খরচ ২০২৫ সালে আরও কমে আসবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে ব্যাটারিযুক্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় সস্তা হয়ে দাঁড়াবে। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সৌরবিদ্যুৎ হতে পারে সস্তা বিকল্প। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ-ই অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী।
বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের মহাপরিকল্পনা অনুসারে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশ আসার কথা। কিন্তু এরপর আরও তিন বছর পেরিয়ে গেলেও, এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের জন্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে কমপক্ষে ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। যদিও সরকার নতুন মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে চায়। তার মানে ওই সময় ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ২৪ হাজার মেগাওয়াট হতে হবে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করা হবে। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা আছে ১ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট। যার মধ্যে ৯৯২ মেগাওয়াটই সৌরবিদ্যুৎ। বায়ু থেকে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৩ মেগাওয়াট। আর বায়োগ্যাস ও বায়োমাস মিলে আছে ১ মেগাওয়াট। এর বাইরে পানি থেকে ২৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতা থাকলেও তা থেকে উৎপাদন হচ্ছে খুবই কম।
এদিকে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে এরই মধ্যে দেশের ১৩টি এলাকায় গবেষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারে দুটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ফেনীতে ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয় প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটির উৎপাদন সক্ষমতা ১ মেগাওয়াটের কম। ২০০৮ সালে কক্সবাজারে ১ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। একই এলাকায় ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও একটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র গত বছর উৎপাদনে এসেছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জে ২ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তবে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে পানি ও বায়ুবিদ্যুতের চেয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
সা¤প্রতিক মাসগুলোয় বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে সৌরবিদ্যুতের অংশ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। এর আওতায় ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যমান সৌরবিদ্যুৎ ৩ শতাংশের নিচে থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারি সূত্রমতে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার জামালপুরে ৫ থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট সোলার বিদ্যুৎ উৎপাদন হাব তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১০০ মেগাওয়াট এবং রাজবাড়ীর সদর উপজেলায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সরকারের অনুমোদন পেতে বেসরকারি খাতে আরও তিনটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রক্রিয়াধীন। একই সঙ্গে, এ খাতকে আরও শক্তিশালী করতে দ্রæতই নতুন ‘রিনিউয়েবল এনার্জি পলিসি’ তৈরি হতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকবে।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ বৈশ্বিক বায়ুশক্তি ক্লাবে যোগ দিয়েছে; যা বাণিজ্যিক বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে (নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে) নতুন মাইলফলক। উলিং পাওয়ার করপোরেশন সবুজ শক্তির উন্নয়নে কাজ অব্যাহত রাখবে এবং বাংলাদেশকে ‘লো-কার্বন’ জ্বালানিতে রূপান্তরে সহায়তা করবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু বিপর্যয় প্রভাব প্রশমনে, বাতাসের গুণমান উন্নয়নে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর দেশের নির্ভরতা কমাতে সহায়তা করবে। এ বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোদমে চালু হওয়ার পর বাংলাদেশকে প্রতি বছর প্রায় ১৪৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং কয়লার ব্যবহার ৪৪ হাজার টন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ১ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টন কমাবে। সেই সঙ্গে ১ লাখ পরিবারের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাবে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নতুন মাইলফলক অর্জন করবে।
অনেক দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির একাধিক উৎস আছে। ওইসব দেশে দিনের বেলায় সৌরবিদ্যুৎ এবং সন্ধ্যার পর পানি ও বায়ুবিদ্যুৎ দিয়ে গ্রিডের সমতা বজায় রাখে। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় লক্ষ্য নিয়েছে। যার বড় অংশই সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রিক। তবে লক্ষ্যপূরণে বিনিয়োগ ও জমির স্বল্পতার অজুহাত দেখাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও ‘বাংলাদেশে সোলার নেট মিটারিংয়ের সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়- রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গা ব্যবহার করে কমপক্ষে ৩৩৩ মেগাওয়াট অতিরিক্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব এবং গবেষণায় দেখা যায়, নেট মিটারিংয়ের মাধ্যমে ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ শিল্প উৎপাদনে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমেছে। দেশে গত ৭ বছরে মাত্র ১১০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ নেট মিটারিং পদ্ধতিতে যুক্ত হয়েছে, বাণিজ্যিক ভবনের মাধ্যমে যার ৫৫ শতাংশ এসেছে ।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রস্তুত করা ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১’-এ বলা হয়েছে, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ফ্যাসিলিটি সম্প্র্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। শুধুমাত্র এক বর্গকিলোমিটার এলাকায় সূর্য থেকে আলো ও তাপ হিসেবে প্রায় হাজার মেগাওয়াট নবায়যোগ্য শক্তি পাওয়া যায়, যেটা একটা নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্রের কাছাকাছি। নদীর তীরবর্তী ও পতিত জমির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুতের সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়াও শুধু বাড়ি ও ভবনের ছাদ ব্যবহার করে-ই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা এবং দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি তৈরির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এই সম্ভাবনা থাকার পরও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ, ২০৪০ সালে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের অনেক সম্ভাবনা আছে। শহরে বাসার ছাদের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে, কীভাবে সবুজায়ন করে একই সক্সেগ সৌর বিদ্যুৎ এর ব্যবহার করা যায় সে প্রযুক্তি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এই জন্য সচেতনতা তৈরি ও প্রযুক্তির খরচ আরও কমিয়ে আনা দরকার। রান্নার জন্য বায়োমাস, শস্য ও কাপড় শুকানোর জন্য সৌরশক্তি এবং বায়ু ব্যবহার একটি ঐতিহ্যবাহী উপায়। এই দিক দিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহƒত হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও প্রতিটি দালানের ছাদে গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করার পাশাপাশি সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে। পাপুয়া নিউগিনিতে নারকেল থেকে বিকল্প জ্বালানি ‘বায়োডিজেল’ তৈরি করা হচ্ছে। এই বায়োডিজেল হচ্ছে জৈবিক উৎস থেকে তৈরি নবায়নযোগ্য জ্বালানি। প্রতি বছর দেশটি ছয় লাখ লিটার নারকেলভিত্তিক জৈব জ্বালানি বা বায়োডিজেল উৎপাদন করেন। এই জ্বালানি তেল (বায়োডিজেল) ব্যবহার করে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সরকারি বিভিন্ন গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশের গাড়ি ও জেনারেটরের পাশাপাশি জাহাজ চালানো হচ্ছে।
একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে শুধু জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে চলা সম্ভব নয়। প্রতিবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অনেক বড় একটি অংশ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হয়। তাই আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অনেক বিনিয়োগের প্রয়োজন। সরকার দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গ্রাহককে ভর্তুকি দিলে মানুষ তখন নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকবে। কারণ সোলার বা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ তুলনামূলক কম দামে উৎপাদন করা যায়। ফলে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন ভবনের ছাদ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কমে আসবে এবং ভ‚-পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও হ্রাস পাবে পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি হ্রাস পাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ ডলার সংকট সমাধান করা সম্ভব হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস করার মাধ্যমে জলবায়ু বিপর্যয় রোধ করে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
আইনজীবী
সধংঁসনরষষধযষধ০ি৬Ñমসধরষ.পড়স