Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 10:22 am

স্মার্ট বাংলাদেশের পথে আমরা

এম জসীম উদ্দিন: ইলা-ইরা দুই বোন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বৈশ্বিক মহামারি কভিডকালে তারা প্রায় ঘরবন্দি ছিল। সেই সময় তাদের পড়ালেখা যেমন থেমে ছিল না, তেমনি ছিল কলেজ এবং বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগও। প্রতিদিনই নিয়ম করে অনলাইন ক্লাস করত তারা। ডিজিটাল সেবার কারণে কভিড মহামারির মতো পরিস্থিতিতেও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর প্রযুক্তির যে বিকাশ হয়েছে, তার সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতি সহজেই মোকাবিলা করতে পেরেছে নতুন প্রজন্মসহ দেশের প্রায় সব বয়সী মানুষ।

কভিড মহামারির কারণে মানুষের ইন্টারনেটনির্ভরতা বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে লকডাউন শুরুর পর থেকে। অনেক মানুষ ঘরে বসেই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছে। স্বাস্থ্যসেবাও নিয়েছে অনলাইনে। এখনও টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের ডাক্তারি পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে। এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশের সফলতা বা অর্জন। এখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছি স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে।

২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ী একটি ঘোষণা। এই ঘোষণা সমাজের সব শ্রেণির বিশেষ করে তরুণ প্রজš§কে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে বেশি। সে ঘোষণার প্রায় ১৩ বছর পর ২০২২ সালের ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের তৃতীয় সভায় দিলেন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্প বাস্তবায়নের ধারণা। ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন।

স্মার্ট বাংলাদেশ হলো বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিশ্রুতি ও সেøাগান, যা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিকল্পনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বপ্রথম এই প্রতিশ্রুতি ও সেøাগান দেন। ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়িত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ পর্ব শেষে আবারও নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারের লক্ষ্যের নাম ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১’। আপাতদৃষ্টিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ একই প্রকৃতির রূপকল্প মনে হলেও ব্যবহারিক ও ধারণাগত দৃষ্টিকোণ থেকে তা বেশ ভিন্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যম। অন্যদিকে স্মার্ট বাংলাদেশ হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী সুসংহত পরিমার্জিত রূপ, যা মূলত সরকারি সেবা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ স্মার্টভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস, যেখানে সব ধরনের ন্যায্য জন-অধিকার আগের তুলনায় অধিকতর সক্ষমতার সঙ্গে নিশ্চিত করার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। মূলত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করার প্রয়াসই হলো স্মার্ট বাংলাদেশ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপ হলো স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য চারটা ভিত্তি ঠিক করা হয়েছে ১. স্মার্ট সিটিজেন; ২. স্মার্ট ইকোনমি; ৩. স্মার্ট গভর্মেন্ট ও ৪. স্মার্ট সোসাইটি।

স্মার্ট সিটিজেন: এই স্তম্ভটির লক্ষ্য থাকবে বাংলাদেশের জনগণকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে মননে ও মেধায় ক্ষমতায়িত করা। ২০৪১ সালের বাংলাদেশের নাগরিককে সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের এবং অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে গড়ে তোলাই হলো স্মার্ট সিটিজেন ধারণা বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য।

স্মার্ট ইকোনমি: বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে উদ্ভাবনীমূলক, যেখানে বাংলাদেশ শিল্পপ্রযুক্তি বিপ্লবের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেবে, বিশেষ করে বস্ত্র, তৈরি পোশাক, হালকা প্রকৌশলসহ কৃষি খাতসমূহে। এই খাতসমূহে একটি স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের মাধ্যমে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি শক্তিশালী তথ্য ও প্রযুক্তি শিল্প গড়ে তুলবে।

স্মার্ট গভর্নমেন্ট: ২০৪১ সালের সরকার ব্যবস্থা হবে অনেকটা ‘অদৃশ্য সরকার ব্যবস্থা’। মানুষ যে-কোনো ধরনের সেবা পাবে কোনো ধরনের মানুষের প্রত্যক্ষ সহায়তা ব্যতীত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জননিরাপত্তা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি একান্ত ব্যক্তিগত সেবাসমূহ হবে সম্পূর্ণ পেপারলেস।

স্মার্ট সোসাইটি: স্মার্ট সোসাইটি বলতে মূলত অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থাকে বোঝাবে, যেখানে সমাজের সব শ্রেণির নাগরিক ও টেকসই জীবনযাত্রা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রযুক্তিগত সহনশীলতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি মানবিক বিষয়াদি নাগরিকদের মধ্যে প্রোথিত থাকবে। স্মার্ট সোসাইটির জীবনযাত্রা হবে স্থিতিশীল, প্রাণোচ্ছল, যার চালিকাশক্তি আসবে একটি সমন্বিত প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম থেকে।

এ বিবেচনায় ২০২১ থেকে ৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও প্রণয়ন শুরু হয়ে গেছে, অর্থাৎ ’২১ থেকে ’৪১ পর্যন্ত সময়ে কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে, তার একটা কাঠামো পরিকল্পনা বাংলাদেশ এরই মধ্যে প্রণয়ন করে ফেলেছে, যা জনগণের জন্য অন্যতম আশীর্বাদ বয়ে আনবে। অন্যদিকে ২০৪১ সালেই শেষ নয়, ২১০০ সালেও এ বঙ্গীয় বদ্বীপ যেন জলবায়ুর অভিঘাত থেকে রক্ষা পায়, দেশ উন্নত হয়, দেশের মানুষ যাতে ‘সুন্দর, সুস্থ ও স্মার্টলি’ বাঁচতে পারে, সেজন্য ডেল্টা প্ল্যান করে দেয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে সরকার দেশের সব নাগরিকের জন্য ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) চালু করেছে, যেহেতু এনআইডি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর একটি ডকুমেন্ট, তাই এর  গ্রহণযোগ্যতা শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, দেশের বাইরেও অনেক বেশি। অথচ বিদেশিরা আগে আমাদের দেশের কাগজপত্র খুব সহজে বিশ্বাস করতে চাইত না। এখানেই দৃশ্যমান হয় ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্ব ও সুবিধা।

এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠনের পাশাপাশি একটি নির্বাহী কমিটিও গঠিত হয়েছে, যারা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরি করবেন। টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির কর্মপরিধিতে বলা হয়েছে, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কার্যকর রূপান্তরে স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আবশ্যকীয় ব্যবস্থা নেয়া, আইন ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো সৃষ্টি এবং সব পর্যায়ে তা কার্যকর কারার দিকনির্দেশনা দেবে এ কমিটি। বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশে ৩৯টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। গবেষণা-উদ্বোধনী কাজে উৎসাহ দেয়া এবং ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমির মধ্যে নেটওয়ার্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ গত ২০২২ সালের ৬ জুলাই উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বর্তমানে সারাদেশে ৯২টি হাইটেক পার্ক/সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক/আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউভেশন সেন্টার স্থাপনের কাজ চলছে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য ৬৪ জেলায় ‘শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার’ স্থাপন করা হচ্ছে, যার মধ্যে তিনটি প্রকল্প অনুমোদিত এবং আরও ৩৪টি জেলায় এটি স্থাপনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী প্রজš§কে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার উপযোগী করে গড়ে তুলতে এবং ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি শিক্ষা দিতে ৩০০টি স্কুল অব ফিউচার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও উদ্ভাবনী। এককথায় সব কাজই হবে স্মার্ট। যেমনÑ স্মার্ট শহর ও স্মার্ট  গ্রাম বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট পরিবহন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট সংযোগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। তার ২০২১ সালের রূপকল্প ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যা অর্জন করে আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ যেমন সফল হয়েছে, তেমনি দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রেও আমরা সফল হব, এই প্রত্যাশা।

পিআইডি নিবন্ধ