স্মার্ট বাংলাদেশ: সব মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে

রেজাউল করিম খোকন:২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠনের পর এই টাস্কফোর্সের একটি নির্বাহী কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যারা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ প্রতিষ্ঠার জন্য নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুপারিশ দেবে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে এই কমিটি। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ঘোষণা দেয়া হয়েছে আগামী নির্বাচনে তাদের সেøাগান হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের সম্মেলনে এই কথা বলেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এই নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ প্রতিষ্ঠার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুপারিশ দেবে এই কমিটি।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বলতে স্মার্ট নাগরিক, সমাজ, অর্থনীতি ও স্মার্ট সরকার গড়ে তোলা হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রম স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তর হবে। এজন্য সরকারি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এবং এর উন্নয়নে একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন করা হবে। টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির কর্মপরিধিতে আরও বলা হয়, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, আইন ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো সৃষ্টি এবং সব পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ ও দিকনির্দেশনা দেবে এই কমিটি। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আর্থিক খাতের কার্যক্রমকে স্মার্ট পদ্ধতিতে রূপান্তরের সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন, স্মার্ট ও সর্বত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক এবং বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিধিমালা প্রণয়ন, রপ্তানির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নীতি প্রণয়ন ও সময়াবদ্ধ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ব্যবস্থা, আর্থিক খাতের ডিজিটাইজেশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এই কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’-এর গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোও বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয়াও হবে এই কমিটির কাজ। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এ নির্বাহী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন বাণিজ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান, জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এ টু আই প্রকল্পের পরিচালক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কলসেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের সভাপতি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব (সদস্য সচিব)। অবশ্য কমিটি প্রয়োজনে আরও সদস্য নিতে পারবে। কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে গেলেও দেশের অর্থনীতি এখনও যথেষ্ট গতিশীল ও নিরাপদ। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এগিয়ে যাচ্ছে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশ আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে। একসময় দারিদ্র্যপীড়িত, খরা-মঙ্গা-বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত জনপদের দেশ হিসেবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু গত কয়েক দশকের পথপরিক্রমায় এদেশের মানুষ অনেক অসাধ্য সাধন করেছে। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত গোটা বিশ্বে। গত এক দশকেরও বেশি সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। জীবনযাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, আর্থিক লেনদেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, বিনোদন, গবেষণা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সবকিছুকেই সহজ ও সাবলীল করে তুলেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণার বাস্তবায়ন দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে সন্দেহ নেই। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে নানা প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমাদের অনেক আশবাদী করে তুলেছে সরকারের বিভিন্নমুখী তৎপরতা। তবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এর অনুষঙ্গ হিসেবে অনেক কিছুই প্রয়োজন, যা এখনও শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ, দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের আহরণ এবং তার উপযুক্ত ব্যবহার ঘটানো।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলমান উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় সমসাময়িক সংস্করণ। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচিত নানা বিষয়ের মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিষয়টি একটি অন্যতম অনুষজ্ঞ। এ বিপ্লব রোবটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম, কম্পিউটিং, ব্যায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস, থ্রিডি প্রিন্টিং, সম্পূর্ণ স্বচালিত যানবাহন ও উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। এর ভিত্তি হিসেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন, বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের চিন্তা জগতে পণ্য উৎপাদন ও সেবা প্রদানে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, পৃথিবীর গতি প্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সক্ষমতাকে বড় ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল পেতে দেশের সবাইকে উপযুক্ত করে তোলাটাও জরুরি এ ক্ষেত্রে। কারিগরি শিক্ষার যথাযথ বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়নি এখন পর্যন্ত। অথচ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যাবতীয় বিষয় ভালোভাবে রপ্ত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এখন দেশের তরুণ বয়সী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয় নিয়ে বেশ আগ্রহী। এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে নিজেদের সময়ের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে মানানসই এবং উপযুক্ত করে তুলতে তাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে বিরাট সহায়ক নিঃসন্দেহে বলা যায়। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ এবং এর সুষম ব্যবহার আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে করেছে ত্বরান্বিত। মোবাইল ব্যাংকিং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে, একথা বললে খুব বেশি বলা হবে না। আমাদের অর্থনীতিতে গত এক দশকে অনেক সমৃদ্ধি ঘটেছে, উন্নয়নের নতুন নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। এসবের পেছনেও রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের উদ্ভাবনী সেবা। দেশের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগী মনোভাব আমাদের সবাইকে উৎসাহী করেছে। তাদের দ্রুত বর্ধনশীল ও গতিশীল সেবা গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে। উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে এখন বাংলাদেশ। নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশ। এরপর মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ। এখন বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে উন্নত দেশ হওয়ার। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া। মাথাপিছু কম জমি নিয়ে বাংলাদেশের মতো আর কোনো দেশ এত অর্থনৈতিক উন্নয়নে করতে পারেনি। এজন্য আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বেশি সংযুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশ অগ্রগতির নানা ধাপ অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। অথচ একসময় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দরিদ্র দেশের তালিকায়। তলাবিহীন ঝুড়িও আখ্যা দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। কিন্তু গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি সহজেই চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়। তর তর করে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। ছোট একটি ভূখণ্ডে আমরা অনেক মানুষ বাস করি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি। মোট আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে অভাব, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব রয়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, বাংলাদেশ ঠিক সেভাবে এগিয়ে যেতে পারছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি একসময়ে পুরোপুরি কৃষিনির্ভর ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তৈরি পোশাকশিল্প। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে উজ্জ্বল অবস্থানে পৌঁছে গেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের আগের রেকর্ড অতিক্রম করে চলেছে। এছাড়া আমাদের রপ্তানি পণ্য তালিকায় নতুন নতুন আইটেম যুক্ত হচ্ছে। আজকাল বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন শিল্পজাত সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স পণ্য পৃথিবীর অনেক দেশে যাচ্ছে। এগুলোর বেশ ভালো চাহিদা রয়েছে। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে একসময় বাংলাদেশের যে পরিচিতি ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, তা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে সময়ের পালাবদলে। প্রযুক্তির নানা বিকাশ, শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির রাজত্ব গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কাঠামোয় এনেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এখন বিশ্বব্যাপী কারিগরি জ্ঞানের কদর খুব সহজেই চোখে পড়ে। বিদেশে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এক কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাঙা ভাব সৃষ্টি করে রেখেছে অনেক দিন ধরে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অগণিত মানুষ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। জনশক্তি খাত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে বর্তমানে তা আরও কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। কারণ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অদক্ষ ও কারিগরি জ্ঞান না থাকা অশিক্ষিত কর্মীরা অন্যান্য দেশের দক্ষ অভিজ্ঞ কারিগরি জ্ঞান জানা শিক্ষিত কর্মীদের তুলনায় অনেক কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অদক্ষ ও আধা দক্ষ কারিগরি জ্ঞান না থাকা শ্রমিক এবং কর্মীদের বেতন নিয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও মালিকের সঙ্গে দরকষাকষির সুযোগ থাকে না। তারা অন্যান্য দেশের কারিগরি জ্ঞান থাকা শিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক ও কর্মীদের তুলনায় এক্ষেত্রে অনেক দুর্বল ও অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। ফলে তারা উচ্চ হারে পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে না। অনেকটা বাধ্য হয়ে তারা অপেক্ষাকৃত কম বেতনে সেখানে কাজ করে। এ কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে বাংলাদেশ এখনও বেশ অনেকটা পিছিয়ে আছে। ফলে বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এ খাত থেকে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারত। যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তেমন উপযুক্ত কাজ নিয়ে বাংলাদেশের কর্মীরা বিদেশে যেতে পারে, তাহলে প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে অন্যান্য দেশের কর্মীদের টেক্কা দিতে পারবে। বাংলাদেশের কর্মীরা অনেক পরিশ্রম করে বটে, কিন্তু কারিগরি শিক্ষা না থাকায় তাদের অদক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তারা তাদের শ্রমের উপযুক্ত মূল্যও পাচ্ছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের স্বল্প বেতনে চাকরি করে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন পক্ষের দক্ষতার ওপর উৎপাদনশীলতা নির্ভরশীল। উৎপাদনে নিয়োজিত বিভিন্ন পক্ষের দক্ষতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে না পারলে কোনো প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক দক্ষ হলেও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং গৃহীত কৌশলের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে দক্ষতার পুরো মাত্রার ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।

একটি বিষয় সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবেÑআমাদের যে বিপুল জনসংখ্যা, তাকে জনশক্তি বা জনসম্পদে রূপান্তর করতে না পারলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে। দিনে দিনে ভয়াবহ সংকট আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি প্রভৃতি অনাকাক্সিক্ষতভাবে বাড়তেই থাকবে। জনবহুল একটি দেশের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ যদি কর্মক্ষম ও উপার্জনক্ষম হয়, তাহলে সেদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই মজবুত হতে বাধ্য। আমাদের জনসংখ্যাকে আপদ না ভেবে জনশক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা চালাতে হবে, তখন তা জনসম্পদে পরিণত হবে। আমরা জনসম্পদকে দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে কাজে লাগাই না কেন, তা আমাদের জন্য সমৃদ্ধির নতুন বার্তা বয়ে আনবে। অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করবে। জনশক্তিকে কারিগরি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে জনসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এটা দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার সঠিক ও কার্যকর উপায়। বেকার, কারিগরি জ্ঞানশূন্য তরুণ-তরুণীদের মেধা, শ্রম ও মননশীলতাকে যথার্থভাবে কাজে লাগাতে না পারলে আমাদের জাতীয় জীবনে আরও অনেক দুর্যোগ এসে হানা দিতে পারে। আমরা কোনোভাবেই তা চাই না। দেশকে সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝাকে অভিশাপ মনে না করে আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষার বিস্তার এর কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাই আমাদের অর্থনীতির চেহারাটা আরও বদলে দিতে পারে। দেশে তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভালো বেতনে চাকরি নিয়ে যেতে পারে তারা। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে উপযুক্ত এবং ভালো বেতনে চাকরির সুযোগ পেতে পারে তারা অনায়সেই। এভাবে আমাদের প্রবাসী রেমিট্যান্স ধারায় বিপুল জোয়ার সৃষ্টি হতে পারে।

স্রেফ বিশেষ একটি দলের কিংবা গোষ্ঠীর নির্বাচনী সেøাগান কিংবা কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যথার্থ উন্নত আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সেক্টরের মানুষকে সম্পৃক্ত করে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে এজন্য। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা মেধাবী মানুষকে খুঁজে বের করে তাদের মেধা ও যোগ্যতার উপযুক্ত মূল্যায়ন করতে হবে। এদেশের বহু মেধাবী মানুষ উপযুক্ত মূল্যায়ন না পাওয়ার কারণে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। তাদের দেশের মধ্যে কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহী করে তুলতে হবে। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অসুস্থ রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চর্চা, চাঁদাবাজি, সামাজিক অনাচার, বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা, স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম, অগণতান্ত্রিক মনোভাব ও দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে আবশ্যিকভাবেই। এজন্য সুনির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে নিয়ে গোটা কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে মূল গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না কোনোভাবেই। মনে রাখতে হবে, স্মার্ট বাংলাদেশ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ধ্যানজ্ঞান ও চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০