আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: ব্যক্তি ও সামাজিক উন্নয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো শিক্ষা। সুশিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে, যা মানুষের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে তুলে এবং সৃষ্টিশীল কাজে চালিত করে। তাই বোধ-বুদ্ধির বয়স থেকে শুনে এসেছি ‘সুশিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। এজন্য-ই সুশিক্ষার মাধ্যমে মানুষের কাক্সিক্ষত আচরণগত স্থায়ী ও ইতিবাচক পরিবর্তন হয়। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুরা নানা জটিলতায় সম্মুখীন হচ্ছে। সামাজিকীকরণের সুযোগের অভাবে শিশুদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব, একাকিত্ব ইত্যাদি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা সমাজকে আলোকিত করতে না পারার কারণে মানুষের আচরণকে স্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারেনি। তাই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি সয়লাভ করছে, অবক্ষয় হয়েছে নৈতিকতার। কুলশিত হয়েছে সমাজ ব্যবস্থা। এখানেই শেষ নহে, এজন্য-ই মানুষ বনভূমি কেটে সাবাড়, জলাধার ভরাটের মাধ্যমে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের মতো কার্যক্রমে যুক্ত।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে একটি সাধারণ ধারণা লাভ করা যায় মাত্র। অবশ্য উপনিবেশিক আমলে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত তথ্য এ সময়ের শিক্ষার উন্নয়নের ধারা সম্পর্কে অধিকতর সুসঙ্গত বিবরণ বিদ্যমান। ছয়-সাত শতকের নালন্দা মহাবিহারের সঙ্গে বাংলার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বাংলার বৌদ্ধ বিহারগুলোর প্রত্যেকটিই ছিল বৌদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র। আমাদের দেশে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময় উডস এডুকেশনাল ডেসপাচের মাধ্যমে শিক্ষানীতি বা শিক্ষা কমিশনের যাত্রা শুরু। ১৮৮২, ১৯০১, ১৯২৭ সালে আরও তিনটি শিক্ষা কমিশন হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে মওলানা আকরম খাঁ শিক্ষা কমিশন দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টা হয়। তারপর ১৯৫৭, ১৯৫৮, ১৯৬৪ ও ১৯৬৯ সালে পরপর আরও চারটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। পরে ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক শামসুল হক, ১৯৮৩ সালে মজিদ খান, ১৯৮৭ সালে মফিজ উদ্দিন, ১৯৯৭ সালে শামসুল হক, ২০০১ সালে এমএ বারী, ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান মিঞা এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালে কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, বর্তমানে যা কার্যকর রয়েছে। কোনো শিক্ষা কমিশনই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেনি।
‘১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন’ প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীদের অবস্থান জোরদার করে। প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, বয়স্ক শিক্ষার প্রবর্তন, পেশাভিত্তিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ এবং নারী শিক্ষা ও অপরাপর অ-সুবিধাভোগী শ্রেণির শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ প্রভৃতি প্রাদেশিক সরকারগুলোর উন্নয়ন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাদেশিক সরকারগুলোর কর্তৃক দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন প্রণয়ন ছিল ১৯২১ এবং ১৯৪৭-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক বৈশিষ্ট্য। এ আইনগুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে তাদের নিজ নিজ এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার ক্ষমতা প্রদান করে। ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাধ্যমিক শিক্ষার দাবিও বৃদ্ধি পায়। ফলে গ্রাম ও উপ-শহরে বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যা মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে। এসব স্কুলে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলো পড়াশোনা করতে পারত। এ সময় নারী শিক্ষার প্রতিও যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া হয়। বর্তমান বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্টÑপ্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হলো শিক্ষার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দপ্তর। এর অধীন কয়েকটি অধিদপ্তর রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তোতা পাখির ন্যায় না বুঝেই শিক্ষাগ্রহণ এবং নিছক মুখস্থকরণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সেখানে অত্যধিক প্রতিযোগিতা এবং ঘনঘন পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ১২ বছরে শিক্ষার্থীকে চারটি পরীক্ষার পুলসিরাত পার হতে হয়। এই পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া গেলেও জ্ঞানের সীমা থাকে প্রান্তিকতম পর্যায়ে। কীভাবে চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে হয় তা শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে না। তাদের অবসর যাপনের সময় ও সুযোগও কম বিধায় তারা অন্যান্য জ্ঞানার্জন ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। উল্লেখিত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে বিকল্প ভাবনার শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষানীতি ৪টি সি’এর ওপর আলোকপাত করা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় সমালোচনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সহযোগিতা এবং সৃজনশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। তাই শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গেই বর্তমান যুগের শিক্ষার সংগতি হওয়া দরকার।’
বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তি নিশ্চিত করলেও জ্ঞানের গভীরতা তৈরিতে অসমর্থ বলা চলে। ফলস্বরূপ ভালো ফলাফল (ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট) করলেও পাঠ্য বিষয়ে জ্ঞান থাকে সীমিত। আমাদের মধ্যে অনেকে নিজকে অনেক জ্ঞানী মনে করে একাডেমিকভাবে মেধাবী শিক্ষার্থী তার জন্য। আমাদের শিক্ষিত বা জ্ঞানী হতে হলে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞান অর্জন করার দরকার বটে। জ্ঞান অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় বই পড়া, ভ্রমণ করা এবং স্থিরচিত্র বা চলচ্চিত্র দেখা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৯৮ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী মাজহারুল আনোয়ার পরিচালিত বাংলাদেশে মুক্তি প্রাপ্ত ‘পরাধীন’ সিনেমা। ওই সিনেমায় বিচার কার্য শেষে অপরাধীকে কারাগারে না পাঠিয়ে আদালত প্রবেশন প্রদান করার বিষয়টি ফুটিয়ে তুলছেন।
বাংলাদেশে অবহেলিত শিক্ষা খাতের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত হলো প্রাথমিক শিক্ষা। অথচ পৃথিবীর সব উন্নত দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় বেশি জোর দেয়া হয়। সাবেক জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হলো টপ হেভি (যদ্যপি আমার গুরু)। অর্থাৎ ওপরের দিকটা ভারী, নিচের দিকটা হালকা। আমাদের দেশে তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ ও চতুর্থ শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকমতো বাংলা পড়তে পারছে না, কিছু দিন আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। এর আগেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হলেও তাদের সবার ঠিকমতো পড়ার দক্ষতা তৈরি হয় না। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি জরিপেও দেখা যায়, প্রাথমিকের মাত্র ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে। ইউনেসকো পাঁচ বছর আগে এক গবেষণায় বলেছে, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার সবচেয়ে কম। শিক্ষকেরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পান না।
পৃথিবীতে শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি-ই যুক্তরাষ্ট্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার ১০০১ নম্বরে। চারটি মানদণ্ডে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়ন করে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তা হলো: শিক্ষা প্রদান, গবেষণা, জ্ঞান বিতরণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। সম্প্রতি ভালো থেকে খারাপের সূচিতে বিশ্বের ৯৩টি দেশের ১৫শ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা করে টাইমস হায়ার এডুকেশন। এখানেই শেষ নয়, অতি সম্প্রতি এশিয়ার ৩১টি দেশের ৭৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এবারের ‘এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং ২০২৪’ প্রকাশ করছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই)’। প্রকাশিত এ তালিকায় এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম আসেনি। গবেষণা না থাকার কারণে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শতকরা ৪৭ শতাংশ বেকার। তারপরও অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২৩’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওই তথ্য মতে-শিক্ষা, কাজে বা প্রশিক্ষণে নেই, বাংলাদেশে এমন তরুণের সংখ্যা ৩৯.৮৮ শতাংশ। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪০.৬৭ শতাংশ।
বিশাল দেশ কানাডা তবুও সেখানে এখন পর্যন্ত মাত্র ৯৬ বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আর আমাদের এই ছোট দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ১৫৬টি হয়ে গেছে, সংখ্যা আরও বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাড়িয়ে কী লাভ? যদি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা না যায়, আর এত শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের চাকরি দিবে কে? শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা কেন পিছিয়ে আছি? কিন্তু আজকের এই সমস্যা এক দিনে হয়নি। এজন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশ শাসন আমলে। ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করতে আসে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য দুটো জিনিস খুব প্রয়োজন ছিল, একটা হলো কেরানি শ্রেণির মানুষ। যারা চেয়ার টেবিলে বসে কেরানিগিরি করবে, কোনো প্রশ্ন করবে না, কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সৃজনশীল হবে না। আরেকটা জিনিস ইংরেজি ভাষা শেখানো। ভাষা না সেখালে তারা এখানে বেশি দিন টিকতে পারবে না।
ইংরেজি সবচেয়ে বেশি বলা মানুষের ভাষার না হওয়া শর্তেও আজ বাংলাদেশে ইংরেজি নিয়ে মাতামাতি। অথচ চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানি এসব দেশে ইংরেজি নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই। তবুও দেখুন এসব দেশ কোনো দিক থেকে কারও থেকে পিছিয়ে নেই। এখানে ইংরেজির গুরুত্ব এতটাই দেয়া হচ্ছে যে, মানুষ ভাবতে বাধ্য হচ্ছে ইংরেজি না জানলে জীবনে কিছু করা যাবে না। একটা ভাষাকে এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষাপদ্ধতি পৃথিবীতে (এক নম্বর) তালিকার শীর্ষে রয়েছে। সেখানে কোনো পরীক্ষা নেই, কোনো প্রাইভেট স্কুল নেই, কোনো গৃহশিক্ষকও রাখা হয় না। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীদের মাঝে কোনো হতাশা দেখা যায় না। প্রতিযোগিতাকে নয়, এখানে পারস্পরিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। ৭ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ৯ বছর বয়সে ফিনস শিশুরা বাধ্যতামূলক স্কুলে যায় এবং সারাদিনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট নামমাত্র কিছু বাড়ির কাজ করে। শিশুদের বাইরে খেলাধুলার জন্য কিছুক্ষণ পর পর বিরতি দেয়া হয়। এ ধরনের শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সমতা তৈরি করা হয়।
অন্য আরেকটি পন্থা হলো শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষা। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা বয়স বা শ্রেণি নয়, শিক্ষার ধরন বা রীতি অনুসারে দলবদ্ধ হয়ে শিক্ষাগ্রহণ করে। শিক্ষকরাও একত্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গোল হয়ে মেঝেতে বসেন। এমনকি এখানে ক্লাসের সবচেয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদেরও কথা বলতে, শুনতে, মন্তব্য করতে এবং চিন্তা করতে উৎসাহিত করা হয়। এই জাতীয় স্কুলগুলো হাসি, আনন্দ, সহযোগিতা ও খেলাধুলার মাধ্যমে সক্রিয় শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে। এতে করে শিশুরা ভালো থাকে এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করে। খেলাধুলা, সক্রিয় স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সামাজিকীকরণ জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সক্রিয় খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, বুদ্ধিগত কর্মক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের বিকাশ, দলগত কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি শিখতেও সহায়তা করে। জীবনের ভারসাম্যকে কেন্দ্রবিন্দু করে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি উন্নত সমাজ গড়ার দিকে মনোনিবেশ করলে ভবিষ্যৎ আরও সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হতে পারে।
সুইজারল্যান্ডের যত জনসংখ্যার তার চেয়ে বেশি আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীর (পড়ালেখা করে) সংখ্যা, কিন্তু তারপরও গবেষণায় বা নতুন কোনো কিছু তৈরিতে সুইজারল্যান্ড নাম্বার ওয়ান আর বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার জিততে পারেনি। অথচ আমেরিকায় এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানে শতাধিক নোবেল জিতেছে। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য আবার পড়াশোনা শুরু করতে হয়। ঘানার রাজধানী কোথায়? সোমালিয়ার মুদ্রার নাম কি অথবা সুন্দরবনের বনের রং কেমন ইত্যাদি, এসব জিনিস জানতে হয় আমাদের। এসব আমাদের কোনো কাজে আসে, এটা কেউই বলতে পারেন? এটা দিয়ে কোন ধরনের মেধা যাচাই করা হবে, সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন?
(ধ+ন)২=ধ২+২ধন+ন২ { (এ প্লাস বি হৌলস্কয়ার সমান স্কয়ার পাস টু এবি পাস বি স্কয়ার)}। সারাজীবন স্কুলে এটা মুখস্থ করানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। কিন্তু কেউ জানে না, এই সূত্রের বাস্তব প্রয়োগটা আসলে কোথায়? শুধু ছাত্ররা-ই না বরং স্কুলের শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক নিজেও জানেন না এটার ব্যবহার কোথায়। এখানে কে কী পারে, কার কোন বিষয়ে মেধা আছে, সেটা কেউ কোনো দিন খোঁজ করে না। এখানে সবাইকে সেই একই সিলেবাস, একই গদবাঁধা পড়াশোনা করে একটা যন্ত্রে রূপান্তরিত করা হয়। এখন আপনারাই বলুন আমাদের এই দেশের আসলেই কোনো উন্নতি হবে? এভাবেই কি চলতে থাকবে সারা জীবন?
অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ইউম্যান। আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি, ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক। ইতিবাচক শিক্ষা ও জ্ঞান আমাদের বিবেককে সমৃদ্ধ করে। এক দেশের যে কথা বা বাক্য কটূক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়, আবার অন্য আরেক দেশে তা ভালো ব্যবহার হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণÑহিসেবে ধরুন: বাংলাদেশে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো অপমানের হলেও পশ্চিমা বিশ্বে ইহা উত্তম আচারণ বটে। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা একটি দেশে ৩টি করে রাজধানী আছে, যা আমাদের অনেকেরই চিন্তার বাইরে। কিছু মানুষ মনে করতে পারেন, বাস্তবে এটা কি করে সম্ভব! মধ্যপ্রাচ্যে কারও সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার সময় ১ ফুটের বেশি দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলা চরম অভদ্রতা। আবার অনেক দেশে এত কাছে অবস্থান করে কথা বলা চরম অভদ্রতাও বটে। ল্যাটিন আমেরিকার স্যামুলাই অঞ্চলে কোনো পরিচিত মানুষের সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হলে তারা তাদের পরিচিত জনের কাঁধে হাত দিয়ে আঘাত করে বলতে হয়, কেমন আছো? এই আচরণ সেখানে ভদ্রতা বলে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তা আমাদের দেশে হয় কি? সংস্কৃতির মাধ্যমে শিক্ষার কিছু জানতে পারেন যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সিনেমা: দূর দেশ (১৯৮৭) দেখলে বোঝা যায়, সেখানে এশিয়ার সংস্কৃতি ও কানাডার সংস্কৃতি কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে।
জ্ঞানকে মহাসমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করলেও অনেক সময় যৌক্তিক জ্ঞান মহাবিড়ম্বনার কারণও বটে। তবুও জ্ঞান অর্জন করুন। পবিত্র কোরান শরীফের সুরা আলাক’র নাজিলকৃত ১ম আয়াত বাংলা অর্থ দাঁড়ায় : পড়, জ্ঞান অর্জন করো। সুশিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকারও বটে। এটি জনস্বার্থে এবং জনসাধারণের জন্য তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬ অনুচ্ছেদে শিক্ষার অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে। ওই ঘোষণায় বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বলা হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বদলে যাবে এসএসসি পরীক্ষার নাম, আসছে নতুন পদ্ধতি। নতুন কারিকুলামে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। যেখানে নতুন পদ্ধতিতে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে নতুন নামকরণের ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, আগামী ২০২৬ সালে নতুন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। সে হিসাবে যে শিক্ষার্থীরা বর্তমানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তারাই প্রথমবার নতুন কারিকুলামের এই ‘এসএসসি’ পরীক্ষায় অংশ নেবে। এর মধ্যে একটি অংশের মূল্যায়ন হবে বিদ্যালয়েই শিখনকালীন। বাকি আরেকটি অংশের মূল্যায়ন হবে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীন। এর মধ্যে একটি অংশের মূল্যায়নে অনুসন্ধান, প্রদর্শন, মডেল তৈরি, উপস্থাপন, পরীক্ষণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয় থাকবে। অর্থাৎ হাতে-কলমে শেখার বিষয়টি মূল্যায়ন করা হবে। আরেকটি অংশে থাকবে লিখিত পরীক্ষা। এছাড়া ১৯৮৯ সালে গৃহীত শিশু অধিকার সম্পর্কিত কনভেনশন আরও এই শর্তে আরোপ করে যে, দেশগুলো মানসম্পন্ন উচ্চতর শিক্ষা সবার কাছে প্রবেশযোগ্য করবে।
শিক্ষাই স্থায়িত্বশীল (টেকসই) উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষা কি শুধুই গদবাঁধা বই পড়া। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে যখন এটি স্থায়িত্বশীল বিকাশের জন্য স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর এজেন্ডা গ্রহণ করেছিল, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি জানায়, তার ১৭টি লক্ষ্যের সাফল্যের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্য ৪, বিশেষত ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক, গুণগত, ন্যায়সঙ্গত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগগুলো উন্নীত করা। সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং জীবন সুযোগ নিশ্চিত করা ছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের (লাখ লাখ শিশু, যুবক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের) পেছনে ফেলে দিচ্ছে, যা লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং দারিদ্র্যের চক্রকে ভেঙে ফেলতে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তাই জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগগুলো প্রচার করতে আমাদের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন ৪ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা এগিয়ে নিতে আরও অনেক কিছু করতে হবে’। আমাদের আচরণকে স্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন করতে হলে সুশিক্ষার বিকল্প নেই। এজন্য জনৈক দার্শনিক বলেছেন, ‘শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য বের হয়ে যাও’।
আইনজীবী