ইসমাইল আলী: দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ফিটনেসহীন যানবাহনকে। এছাড়া অদক্ষ চালক, যানবাহনের অবৈধ প্রতিযোগিতা, ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক প্রভৃতি কারণও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তবে এগুলো বাদ দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে নেয়া হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প।
‘বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণ ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ পুলিশ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রকল্পটির আওতায় বেশকিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা-জয়দেবপুর-জামালপুর (এন৪) মহাসড়ক ও ঢাকা-রাজশাহী (এন৬) মহাসড়কের ৭০ কিলোমিটার অংশকে নিরাপদ করিডোর হিসেবে গড়ে তোলা; দুই জেলায় সড়ক নিরাপত্তা উদ্যোগ (জেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি গঠন, পথিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সেবা, হাসপাতাল স্টাফদের প্রশিক্ষণ প্রভৃতি) বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা; দুই জেলায় দুটি অটোমেটেড ভেহিক্যাল ইন্সপেকশন অ্যান্ড সার্টিফিকেশন ও দূষণ পরীক্ষাগার স্থাপন; নির্বাচিত মহাসড়কের আট হাজার কিলোমিটারের জন্য অ্যাকশন প্রোগ্রাম গ্রহণ ও পুনর্বাসন অ্যাকশন প্রোগ্রাম প্রণয়ন, সড়কের ছোটখাটো (মাইনর) মেরামত ও ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলো সড়ক সাইন-মার্কিং প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ; ক্র্যাশ ডেটা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ও প্রায়োগিক ব্যবস্থার উন্নয়ন; জেলা হাসপাতালগুলোয় ট্রমা নিবন্ধন ও ট্রমা কোয়ালিটি উন্নয়ন এবং জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর (সওজ, বিআরটিএ, বাংলাদেশ পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) সক্ষমতা বৃদ্ধি করা উল্লেখযোগ্য।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৫৩৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেয়ার কথা তিন হাজার ৮৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার দেবে এক হাজার ৪৪৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর পরামর্শক খাতেই ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৪২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া জমি অধিগ্রহণে ৫০০ কোটি, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ১০০ কোটি ও পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরে ৩০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা
হয়েছে। আর সড়ক পেভমেন্ট নির্মাণে দুই হাজার ১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং ভবন নির্মাণে ৪৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
এর বাইরে অ্যাম্বুলেন্স কেনায় ৩৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যানবাহন কেনায় ৩২ কোটি ২৯ লাখ টাকা, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনায় ২৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, তিনটি হাসপাতাল (টাঙ্গাইল জেলা হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতাল) সংস্কারে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে সফটওয়্যার কেনায় ১৭৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
এদিকে প্রকল্পটির প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাতে ২৪১ কোটি ১৪ লাখ টাকা, সিডি/ভ্যাট খাতে ৭০ কোটি টাকা, ফিজিক্যাল কনটিনজেন্সি (দুই শতাংশ) ৮৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ও প্রাইস কনটিনজেন্সি (পাঁচ শতাংশ) ২১১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। চলতি বছর মার্চে শুরু করে ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ পাঁচ বছরে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
সড়ক নিরাপত্তায় মেগা প্রকল্প নেয়া হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান খোদ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অতিরিক্ত সচিব শেয়ার বিজকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ ফিটনেসহীন গাড়ি ও চালকদের অদক্ষতা। এছাড়া যানবাহনের অবৈধ প্রতিযোগিতা, ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক, একই সড়কে দ্রুতগতির ও ধীরগতির যানবাহন চলাÑএগুলোও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অথচ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পে এসব বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের কার্যক্রম নেই। প্রকল্পটিতে মূলত সড়ক দুর্ঘটনা-পরবর্তী পুনর্বাসন ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সড়ক দুর্ঘটনা কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তিনি আরও বলেন, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বড় প্রকল্প নেয়া হলেও এর প্রায়োগিক ক্ষেত্র অনেক ছোট। নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলতে মাত্র ৭০ কিলোমিটার করিডোরকে নির্বাচন করা হয়েছে। ফলে এ প্রকল্পের প্রভাবও খুব বেশি দেখা যাবে না। তাই প্রকল্পটির কার্যকারিতা হবে খুবই সীমিত।
এ বিষয়ে জানতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর বলেন, সারাদেশের সড়ক নিরাপত্তা উদ্যোগ একই সঙ্গে বাস্তবায়ন করা কঠিন ও ব্যয়বহুল। তাই এ প্রকল্পটি মূলত পাইলট প্রকল্প হিসেবে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক-মহাসড়কগুলোর জন্য পৃথক প্রকল্প নেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় কার্যক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সুপারিশকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে এটি অনেকটা পাইলট প্রকল্প হওয়ায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে, যা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামনে আসবে। এর ভিত্তিতে পরবর্তী প্রকল্পগুলোয় প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে।