সড়ক যোগাযোগ জিম্মি যখন

গত ২২ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির মামলায় বাসের চালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ন্যক্কারজনক হলো, রায়টি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদে আঞ্চলিকভাবে আহ্বান করা হয় পরিবহন ধর্মঘট। তারপর সোমবার আদালত সাভারে ট্রাকচাপায় এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় চালকের মৃত্যুদণ্ড দিলে মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে শুরু হয় লাগাতার পরিবহন ধর্মঘট। সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী অবশ্য এ ঘটনাকে ‘ধর্মঘট’ বলতে নারাজ। তার মতে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে স্বেচ্ছায় কর্মবিরতিতে গিয়েছিলেন পরিবহন শ্রমিকরা। যা হোক, সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয় গতকালই। পাঠকরা সে বিষয়ে এরই মধ্যে অবগত।

পরিবহন ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। সেগুলোর মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব না হলেও ওই ঘটনায় দেশময় কোটি কোটি যাত্রী যে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন, তা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়; বিশেষত এসএসসি শিক্ষার্থীরা পড়েছিলেন বিপাকে। এক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনে ক্ষতির ইস্যুটি না হয় উহ্যই থাক। প্রথম প্রশ্ন হলো, পরিবহন শ্রমিকদের এমন প্রতিশোধমূলক প্রতিবাদ কার বিরুদ্ধে? সরকারের একাধিক মন্ত্রীই বলেছেন, রায় দিয়েছেন আদালত আর হয়রান হচ্ছে জনগণ! আসামির অপরাধের প্রকৃতি ও স্থানীয়ভাবে অনুশীলিত দৃষ্টান্তের আশ্রয় নিয়ে আদালতের কাছে নিজেদের ‘বঞ্চনা’র কথা জানাতে পারতেনই তারা। সরকারও একটা বৃহৎ সমস্যাকে সমঝোতার মাধ্যমেই সমাধান করতে চায় বলে মনে করেন কেউ কেউ। ফলে শুরুতেই বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা যেত নিশ্চয়ই। সেটি না করে সহিংস মনোভাব নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর মধ্য দিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইলেন তারা—পরিবহন খাত আইনের ঊর্ধ্বে?

শ্রেণিহীন প্রতিবাদের অদ্ভুত নজির জনগণ দেখলো আলোচ্য ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে; যেখানে মালিক ও শ্রমিক এক কাতারে দাঁড়িয়ে লড়েছেন সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই ঐক্যের লেশমাত্র দেখা যায় না পরিবহন শ্রমিকদের মজুরিসহ আর্থিক সুবিধাদি বৃদ্ধিতে কিংবা তাদের উন্নততর প্রশিক্ষণ প্রদানে। অথচ খাতটির সার্বিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে মালিক-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আশু প্রয়োজন। প্রত্যাশা থাকবে, ভবিষ্যতে এর প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দেবেন সংশ্লিষ্টরা।

অস্বীকার করা যাবে না, রাস্তাঘাটের মতো অবকাঠামো নির্মাণে যথেষ্ট মনোযোগী সরকার। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য তা আমাদের দরকারও। কিন্তু কথা হলো, অবকাঠামো নির্মাণ করলেই উন্নয়নকর্ম সমাপ্ত হয়ে যায় না। অবকাঠামোটি উন্নয়নে কতটুকু কাজে আসছে, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশে পরিবহন খাতের জনবল ব্যবস্থাপনা এখনও কত দুর্বল। অথচ অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থেই একে সুব্যবস্থাপনার আওতায় আনা উচিত। এক্ষেত্রে দুটি বিবেচনা রয়েছে: এক. অভ্যন্তরীণ ও দুই. আন্তর্জাতিক। পরিবহন খাতের জনবল সুব্যবস্থাপনায় এলে স্থানীয় যাত্রী ও পণ্য পরিবহন পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটবে বলেই বিশ্বাস। তাতে দুর্ঘটনার সংখ্যাও হ্রাস পাবে। দ্বিতীয়ত. প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ইস্যুটি বাদ দিলেও এশিয়ান হাইওয়ের মতো আন্তর্জাতিক সড়ক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ; এবং তাতে আন্তর্জাতিক মহলেরও আপত্তি নেই। ধরুন, এরই মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ে পুরোপুরি সচল। এখন আদালতের দুটি রায়ের প্রতিবাদে স্থানীয় পরিবহন শ্রমিকরা ‘স্বেচ্ছা কর্মবিরতি’র মাধ্যমে একেবারে অকেজো করে রেখেছে বাংলাদেশ অংশটি। ভাবা যায়, কী ঘটতো সেক্ষেত্রে? সুতরাং বাংলাদেশকে ঘিরে এ ধরনের ভাবনা যেন আন্তর্জাতিক মহলের কল্পনায়ও না আসে, সে লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণই কাম্য এখন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০