শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনে প্রাণ হারায় প্রায় ৯ শতাধিক মানুষ (সূত্র: প্রথম আলো)। বাংলা জনপদটি হয়ে গেল রক্তাক্ত প্রান্তর। স্বাধীনতার পর এ-ই প্রথম কোনো আন্দোলনে ঝরে অসংখ্য প্রাণ। দেশ এই আন্দোলনে যে প্রাণগুলো হারাল তারা সবাই আগামীর প্রজš§। এদের সিংহ ভাগই মেধাবী শিক্ষার্থী। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনকারী কারা এটা জানা দরকার। বাংলাদেশের প্রায় দেড় শতাধিক পাবলিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আরও আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ, স্কুল-কলেজ মাদ্রাসাসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়–য়ারাই হলো বৈষম্য নিরোধ কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী। এরা দেশের সম্পদ, মেধাবী মুখ, যারা আগামীর বাংলাদেশের দায়িত্ব নেবে।
অথচ এদের দেশের কিছু রাজনৈতিক, কথিত সুশীল রাজাকার বলে অভিহিত করে। আর এই কারণেই জ্বলে ওঠে বাংলাদেশ। কারণ রাজাকার অত্যন্ত ঘৃণিত নিন্দিত শব্দ। কেন এই প্রজš§কে রাজাকার বলা হলো। যারা রাজাকার বলেছেন, তারা কি রাজাকারের সংজ্ঞাটি জানেন। রাজাকার হলো তারা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণহত্যা পরিচালনা করেছিল। তাদের হাতে নিমর্ম খুনের শিকার হয় ৩০ লাখ শহীদ। রাজাকার হলো তারা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ছিনিয়ে নিয়েছিল। এবারের বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের বয়স ১৪ থেকে ২১ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এরা কী করে রাজাকার হয়। এদের যারা ‘রাজাকার’ বলেন, তাদের বিষয়টি ভাবতে হবে। এরাই চায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শটি বেঁচে থাকুক।
নতুন প্রজš§কে স্বাধীনতাবিরোধীদের আদর্শের দিকে এরাই ঠেলে দিচ্ছে; যা আগামীর জন্য খুব ক্ষতিকর দিক। বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনটি রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ ছিল। এটাকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার একটা পাঁয়তারা চলে। তাই এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রাজাকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। যারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকার অভিহিত করেছেন তারা প্রকৃতার্থে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ কেন হলো ছাত্রলীগ। এটা তো সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। দেশের একজন মন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এলেন, তিনি ছাত্রলীগের সমাবেশে দাঁড়িয়ে বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। এ ধরনের ঘোষণা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে জাতি আশা করে না। তিনি যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমাবেশে গিয়ে কিছ– কথা বলতে পারতেন। কারণ সরকার তো কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে না।
সংস্কারের পক্ষেই ছিল, এই বিষয়ে উচ্চ আদালতে সরকারই আপিল করেছে। তা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলতে পারতেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোমরা একটু ধৈর্য ধর, এই বিষয়টি নিয়ে সরকার আইনি লড়াই করছেন। তিনি যদি এই কাজটি করতেন তাহলে এত বড় সংকট সৃষ্টি হতো না। ছাত্রলীগকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানানোর ফলে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। প্রতিটি ক্যাম্পাসে চলে হানাহানি, শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায় ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেয় আরেক ভুল পদক্ষেপ। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব মোতায়েন করা হয় ক্যাম্পাসে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হস্তে দমন করতে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাম্পাসকে শান্ত করার নামে চালায় তাণ্ডব। এই তাণ্ডবকে অনেকেই অভিহিত করেছেন নারকীয় লীলা হিসেবে।
যা ১৯৭১ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর হলে ঘটেছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তাণ্ডবে জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো পরিণত হয় রিমান্ড কক্ষে। হলগুলো থেকে বেরিয়ে আসে করুণ আর্তনাদ। হলে আক্রমণের পরের দিন মেট্রোস্টেশন, বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ভবন, প্রাণিসম্পদ দপ্তরসহ সরকারি সম্পদ ধ্বংস করে দেয় দুর্বৃত্তরা? নিহত হওয়া শিক্ষার্থীর তালিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। এখানকার প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার সংখ্যা ২৬৭ জন। ঢাকা শহরের পিতার কোলে অবোধ শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা। প্রশ্ন হলো এই হত্যা ও ধ্বংসের দায় কার? কাদের দোষে এমন নৃশংসতা ঘটল। এই বিষয়টি আগে খতিয়ে দেখা দরকার। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা হলেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবক।
প্রতিটি শিক্ষার্থীর দেখাশোনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের। বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনটি যখন শুরু হয় তখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টর আন্দোলনটিকে কীভাবে দেখেছেন। তারাও কি মনে করেছিলেন এটা রাজাকারদের আন্দোলন? ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রগতিশীল শিক্ষকের ব্যানারে বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনটির বিষয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন এবং এখনও তারা রাস্তায় আছেন। কোনো শিক্ষার্থীদের পুলিশ ধরলে দেখা যাচ্ছে তারা ছুটে যাচ্ছেন। কেন ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টররা এই দায়িত্ব পালন করছেন না। তারা কি ভয় পাচ্ছেন? নাকি পদ হারানোর ভয় তাদের। যদি এতই ভয় থাকে তাদের তাহলে কেন সরকারের পক্ষ নিয়ে প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন না।
তারা যদি প্রথমেই বিষয়টিতে নজর দিতেন তাহলে আজ এতগুলো প্রাণকে অকালে ঝরে যেতে হতো না। ড. জাফর ইকবাল নামে অবসরপ্রাপ্ত জনৈক শিক্ষক তার ফেসবুকে স্বহস্তে লেখা একটি চিঠি স্ক্যান করে দিয়েছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, তিনি আর কোন দিন তার প্রিয় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন না। কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন সেখানে গেলে নাকি তিনি রাজাকারের মুখ (শিক্ষার্থী) দেখবেন। তিনি কি জানেন রাজাকার কাকে বলে? নাকি রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নতুন প্রজš§কে রাজাকার বলে কিম্ভুত কিমাকারের রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তত করলেন। জাফর ইকবাল সাহেবের জš§ ১৯৫২ সালে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স প্রায় ২০ বছর। তিনি ২০ বছর বয়সি যুবক হয়ে সেই সময় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়তে পারেননি। অথচ নতুন প্রজš§কে বিশেষণ দিচ্ছেন রাজাকার।
বৈষম্য নিরোধ কোটা সংস্কার আন্দোলনটি ছিল অরাজনৈতিক । কোটা ব্যবস্থার বিলোপ চায় শতকরা ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী, তাই দাবানলের মতো আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দেশের দায়িত্বশীল মহল কি বিষয়টি প্রেডিক্ট করতে পেরেছিলেন, নাকি না হিসাব করেই একে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে যান। তাদের এই হীন চেষ্টাটি আজ গদগদে ঘায়ে পরিণত হয়েছে। যেহেতু তারা দলকানা, সুস্থ মস্তিষ্কে কিছু বিচার করতে পারে না, রবিন্দ্রনাথের সেই কবিতার মতো বলে বেড়ানÑ যা কিছু হারায়, কেষ্ট বেটাই চোর। কথিত বিবৃতিজীবীদের কুচিন্তা ও মন্তব্যের জেরে কারণেই ঘটল একটি প্রলয়ের মতো হত্যাযজ্ঞ। তাই বুঝতে হবে প্রকৃতার্থে এরা দায়িত্ববান নন।
কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে এরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির কাজ হিসেবে আখ্যা দিলেন, এটা তারা কোন হিসাবে বললেন তার ব্যাখ্যাটা এদের কাছ থেকে নেয়া দরকার। এ ধরনের মন্তব্যে কারণে বাংলাদেশ মুহূর্তের মধ্যে হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। এই আগুনের রোষানলে পড়ে শত শত মায়ের কোল খালি হয়ে গেল। শত সন্তান হারানো মায়ের কানের কাছে এখন এরাই উল্টো সুরে গান গাইছেন। যা দেখে শুধু বলা যাচ্ছে, আশ্চর্য সেলুকাজ এই বাংলাদেশ। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর কি সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে বিচার হবে? দোষী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য তদন্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়। তবে যাদের বেফাস কথা ও দায়িত্ব পালনের অবহেলায় এমন ভয়াবহ রূপ নিল তারা কি শাস্তির আওতায় আসবে?
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যে ক্ষতটি সৃষ্টি হলো তার দাগ জাতিক আরও কয়েশ’ বছর বয়ে বেড়াতে হবে ।