হরলিকসের ‘প্রতারণামূলক’ বিজ্ঞাপনে বিপাকে জিএসকে

মাসুম বিল্লাহ: নিয়মিত হরলিকস পান করলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয় এমন ‘প্রতারণামূলক’ বিজ্ঞাপন প্রচার করে বিপাকে পড়েছে ওষুধ ও হেলথকেয়ার পণ্য বাজারজাতকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন। দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি খাদ্যপণ্যের মান সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন ছাড়াই হেলথকেয়ার সম্পর্কিত ভোগ্যপণ্য হরলিকস বাজারজাত করে আসছে। আর কোনো গবেষণায় প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য গুণাগুণ বিষয়ে অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সম্প্রতি বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে একটি মামলা করা হয়।
জানা যায়, হরলিকসের বাজারজাতকারী গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ লিমিটেড কনজুমার সার্ভিস (জিএসকে) এবং প্রস্তুত ও মোড়কজাতকারী প্রতিষ্ঠান মিউচুয়াল ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড। দীর্ঘদিন ধরে জিএসকে হরলিকসের মোড়কে এটির নামের পরে টলার (লম্বা), স্ট্রংগার (শক্তিশালী), শার্পার++ (মেধা বা বুদ্ধি) লেখা রয়েছে। অর্থাৎ, নিয়মিত হরলিকস সেবন করা শিশুরা সমবয়সী অন্যদের তুলনায় দ্রুত বেড়ে উঠবে এবং বেশি মেধাবী হবে। কিন্তু কোন গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে তার সূত্র উল্লেখ নেই। মূলত পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর লক্ষ্যে এমন চটকদার ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।
আর মোড়কে হরলিকস গ্রহণে ইমপ্রুভ করে বেড়ে ওঠার পাঁচটি লক্ষণ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো অধিক হারের পরিধি, সবল পেশি, অধিক মনোযোগ, স্বাস্থ্যকর রক্ত ও সঠিক ওজন বৃদ্ধি। এসব লেখার নিচে একটি লোগোতে লেখা হয়েছে ‘প্রমাণিত’। প্লাস্টিক বোতলে অনুমোদন ছাড়া ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত লোগো ব্যবহার ও পণ্য মোড়কের গায়ে বিভিন্ন উপকারিতার কথা লেখা রয়েছে। এসব উপকারের মধ্যে রয়েছেÑমজবুত হাড়, সবল পেশি ও এর কার্যকারিতা, মস্তিষ্কের বিকাশ ও তার কার্যকারিতা, এলার্জি ও তার মেটাবোলিজম, স্বাস্থ্যকর রক্ত রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থার স্বাভাবিক কার্যক্রম এবং ফ্লুইড ও ইলেকট্রোলাইটের ব্যালেন্স।
মোড়কের গায়ে আরও লেখা রয়েছে আপনার বাচ্চার পরিপূর্ণ বিকাশের প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রতিনিদিনের খাবারে পূরণ নাও হতে পারে। প্রতিদিন হরলিকস পান করলে ওই চাহিদা পূরণ হয়। একই সঙ্গে হরলিকস ক্ল্যাসিক মল্ট পান না করলে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মোড়কের গায়ে এমন বিষয় উল্লেখ করা ও বিজ্ঞাপন প্রচারকে এক ধরনের প্রতারণা বলে উল্লেখ করেছেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করে এলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তিনি বলেন, ‘যদি কোনো শিশু হরলিকস সেবনের ফলে তার সমবয়সী অন্য শিশুদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তা ও উচ্চতায় বড় না হয়ে থাকে, তাহলে সেই শিশুর বাবা-মায়ের উচিত মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করে জিএসকের বিরুদ্ধে মামলা করা।’ কোম্পানিগুলোর প্রতারণা রোধে ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন তিনি।
এটি যে এক ধরনের প্রতারণা, তার প্রমাণ মেলে শিশুদের কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে। মগবাজার এলাকার এক শিশুর মা শামীমা আক্তার জানান, তার ছেলের বয়স ৯ বছর। বর্তমানে সে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে চার বছর বয়স থেকেই তাকে হরলিকস খাওয়ানো হয়। এক পর্যায়ে নিয়মিত হরলিকস সেবন তার অভ্যাসে পরিণত হয়। কিন্তু বিজ্ঞাপনে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, সেরকম কোনো ফল পাওয়া যায়নি। একই ধরনের অভিযোগ করেন ধানমন্ডি এলাকার ১০ বছর বয়সী এক মেয়েশিশুর মায়ের কথাতেও। জহুরা আহমেদ নামের ওই মা বলেন, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিশুর মায়েদের হরলিকস কেনার ক্ষেত্রে এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি এমন অপকৌশলের বিজ্ঞাপন প্রচার করে এলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবশেষে গত মাসে পণ্যের বিক্রি বাড়াতে অপকৌশল, প্রতারণামূলক এবং আইন ও বিধিমালাবহির্ভূত বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগে জিএসকে ও মিউচুয়াল ফুড প্রডাক্টসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সিটি করপোরেশনের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক ও প্রসিকিউটিং অফিসার কামরুল হাসান এ মামলা করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) অবস্থিত বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে করা মামলায় বিবাদী করা হয়েছে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ লিমিটেড কনজুমার সার্ভিসের চেয়ারম্যান আজিজুল হক, মহাব্যবস্থাপক প্রকাশ পাণ্ডে ও মিউচুয়াল ফুড প্রডাক্টসের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদকে। মামলায় হরলিকসের বিজ্ঞাপন প্রচারে অপকৌশল গ্রহণ, বেআইনি ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগ তোলা হয়েছে। আজ বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হরলিকসের বিজ্ঞাপন আমাদের দেশের প্রচলিত আইন ও বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে অভিযোগ করেছি। তিনি জানান, মামলা করার আগে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে হরলিকসের নমুনা সংগ্রহ এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হরলিকসের বিজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেশের প্রচলিত আইন ও বিধিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের গুণাগুণ বিষয়ে সনদদানকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই থেকে কোনো সনদ না নিয়েই ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এমন প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করে চলেছে জিএসকে। যা দেশের প্রচলিত আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার-সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া ভ্যানিলা ফ্লেভারের মাদারস হরলিকসের বিজ্ঞাপন প্রচারেও একই ধরনের অপকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রসিকিউশন উল্লেখ করেছে, হরলিকস ক্ল্যাসিক মল্ট ও মাদারস হরলিকস ‘ক্লিনিক্যালি ট্রায়াল’ বিজ্ঞানসম্মতভাবে শতভাগ গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া হরলিকস ক্ল্যাসিক মল্ট ও মাদারস হরলিকস বিশ্বের কোন উন্নত দেশ কর্তৃক স্বীকৃত বা অনুমোদিত তা পরিলক্ষিত হয়নি। আর পণ্য দুটি বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিতও নয়। বিজ্ঞাপন ও মোড়কে উল্লিখিত বিষয় লিপিবদ্ধ করা ও প্রচারের মাধ্যমে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান দুটি হরলিকস বিক্রির অপকৌশল নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে জিএসকে বাংলাদেশ কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে ই-মেইলে জিজ্ঞাস্য বিষয় লিখে পাঠাতে বলা হয়। ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানোর পর ফিরতি মেইলে ইংরেজি ভাষায় একটি জবাব পাঠানো হয়। জবাবের ভাষান্তর করলে তার সারকথা দাঁড়ায় এরূপ: ‘আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত যথাযথ আইন মেনে এবং আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সব ধরনের কমপ্লায়েন্স পরিপূর্ণরূপে অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালনা করছি। আর আদালতে যে মামলা হয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে কোম্পানি।’

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০