Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 3:05 pm

হলমার্কসহ ২০ প্রতিষ্ঠানের ২৫৭৮ কোটি টাকা অবলোপন

জয়নাল আবেদিন: ব্যাংকের ইতিহাসে বড় বড় দুর্নীতির মধ্যে অন্যতম ঘটনা হলমার্ক কেলেঙ্কারি। দীর্ঘ আট বছরেও আদায় হয়নি সেসব টাকা। কেলেঙ্কারির ওই অর্থ আদায় করতে না পেরে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে তা বাদ দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হলমার্ক গ্রুপের মাত্র দুই প্রতিষ্ঠানের ৯৯৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা অবলোপন করেছে ব্যাংকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের মোট অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি ২০ প্রতিষ্ঠানের অবলোপন করা হয়েছে ২ হাজার ৫৭৮ কোটি, যা মোট অবলোপনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। অবলোপনের এসব টাকা পরিশোধে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই কোনো আগ্রহ নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সরকারি ব্যাংকে মাত্র ২০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এত টাকা অবলোপন করাটা সন্দেহজনক। খেলাপিঋণের বোঝা কমাতে অবলোপনের পথে হাঁটছে অনেক ব্যাংক। কিন্তু এটাই সমাধান নয়, উল্টো দীর্ঘমেয়াদে সমস্যায় আরও জর্জিত হয়ে উঠবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটি। প্রকৃত রোগ না সেরে চোখের আড়ালে নিয়ে সাময়িক লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু রোগ সেরেছে দাবি করা যায় না।

এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের শীর্ষ ২০ ঋণ অবলোপনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০২০ সালে এই ২০ প্রতিষ্ঠান থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কিন্তু ১৭টি প্রতিষ্ঠান এক টাকাও পরিশোধ করেনি। হলমার্কসহ বিভিন্ন আঘাতে এমনিতেই চাপের মুখে রয়েছে ব্যাংকটি। এরপর এসব অবলোপনের বোঝা সোনালী ব্যাংককে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিচ্ছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

তথ্যে আরও দেখা যায়, বেসরকারি খাতের অবলোপনকৃত ঋণের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে মেসার্স ম্যাক্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড, যা হলমার্ক গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ অবলোপন করা হয়েছে হোটেল শেরাটন করপোরেট শাখার এই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের। ২০২০ সালে অবলোপনকৃত এ ঋণের ১০ শতাংশ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো টাকা পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মেসার্স আনোয়ারা স্পিনিং মিলস লিমিটেড। এটিও হলমার্ক গ্রুপভুক্ত। শেরাটন করপোরেট শাখার এই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানে অবলোপনের পরিমাণ ৪৭৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। চলতি বছরের ৯ মাসে এ প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৪৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আদায় হয়নি এক টাকাও। এ হিসাবে দেখা যায়, হলমার্ক গ্রুপের এই দুই প্রতিষ্ঠানের অবলোপনকৃত মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।

এরপরে রয়েছে হোটেল শেরাটন শাখার গ্রাহক মেসার্স ওয়ালমার্ট ফ্যাশন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ১৭০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এই প্রতিষ্ঠান থেকেও কোনো টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি। চতুর্থ স্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান  মেসার্স নিউ রাখী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। এখন পর্যন্ত ১২৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু আলোচ্য সময়ে আদায় হয়নি এক টাকাও। মেসার্স জাসমির ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার গ্রাহক। চলতি বছরের ১০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও সমাপ্ত ৯ মাসে কোনো টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া এ তালিকায় আরও রয়েছেÑঢাকায় রমনা করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স ফেয়ার এক্সপো, মেসার্স সুমি সোয়েটার লিমিটেড, যশোর করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স আলফা টোব্যাকো, ঢাকায় স্থানীয় কার্যালয়ের গ্রাহক মেসার্স ওয়ান স্পিনিং মিলস লিমিটেড, মেসার্স রিভারসাইড লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার লিমিটেড, মেসার্স এ আর খান সাইজিং অ্যান্ড ফেব্রিকস, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স ইম্পেরিয়াল ডায়িং অ্যান্ড হোশিয়ারী লিমিটেড, ফরিদপুর শাখার মেসার্স রোকেয়া টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার মেসার্স সাহিল ফ্যাশন লিমিটেড, মেসার্স সাহিল নিটওয়্যার লিমিটেড, মেসার্স ইউনিটি নিটওয়ার, মেসার্স কেপিএফ টেক্সটাইল, মেসার্স মুন নিটওয়্যার, আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার মেসার্স ইমাম ট্রেডার্স এবং চট্টগ্রামের লালদীঘি করপোরেট শাখার মেসার্স সিদ্দিক ট্রেডার্স।

ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে দীর্ঘদিন অনাদায়ী টাকা বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে ঋণ অবলোপন বলা হয়। গত ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ’ থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বলা হয়, যেসব ঋণ একাধারে তিন বছরের বেশি সময় অনাদায়ী অথবা মন্দমানের খেলাপি হিসেবে পড়ে আছে, সেসব ঋণ অবলোপন করা যাবে। এর আগে এই সময়সীমা ছিল পাঁচ বছর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ১০ হাজার ৮৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণের ২১ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে আবার ৯ হাজার ৮৮ কোটি টাকাই মন্দ মানের খেলাপি। জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ১৯ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শীর্ষ ২০ বেসরকারি অবলোপনের মধ্যে হলমার্কের টাকাই বেশি। এটার আদায় অগ্রগতি একেবারেই নেই। এটা সবারই জানা। তাছাড়া বেশকিছু অবলোপন আছে অনেক পুরোনো। উল্লিখিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশকিছু টাকা আদায়ও হয়েছে। তবে টাকার অঙ্কটা আমার এখন মনে নেই। টাকাগুলো আদায়ের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’

সোনালী ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা শুভাস চন্দ্র শাহা এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনার কারণে সব ধরনের আদায় অগ্রগতি কম। তবে একেবারেই যে থেমে আছে তা নয়। এই পরিস্থিতিতেও মোট অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৩৩ কোটি টাকা আদায় করেছে সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে ৩২ কোটি টাকাই ক্যাশ রিকভারি, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অতি নগণ্য। তারপরও আদায় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সাল পর্যন্ত হলমার্ক গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিকে বিভিন্ন সময় তিন হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার ঋণ দেয় সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে কিছু অর্থ ফেরত এলেও তিন হাজার ৪৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকা আটকে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভির মাহমুদ ও চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম এবং সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলার বিচার চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে এসব মামলা হয়। ২০১৬ সালে বিচার কাজ শুরু হলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখনও বিচার শেষ হয়নি।