হাইব্রিড এজিএম-ইজিএমের বিধান মানছে না কোম্পানি

আতাউর রহমান: ২০২০ সালের পর থেকে নানা সময়ে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও বিশেষ সাধারণ সভাসহ (ইজিএম) যে কোনো ধরনের বৈঠক হাইব্রিড নিয়মে আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোম্পানিগুলো পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের সশরীরে উপস্থিতি ও অনলাইনে অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে সভার আয়োজন করবে। কিন্তু কোম্পানিগুলো সে নির্দেশনা পুরোপুরি পরিপালন না করে এজিএম ও ইজিএম এখনও শুধু অনলাইনেই আয়োজন করে চলেছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও বিএসইসির নির্দেশনাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। তারা এখনও সশরীরে সভার আয়োজন করছে না। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনার বরখেলাপ বলে জানিয়েছেন কমিশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।

জানা যায়, অনলাইনে সভা করার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক কোম্পানি তাদের অনিয়ম ধামাচাপা দেয়ার সুযোগ নিচ্ছে। কেননা, সশরীরে সভার আয়োজন করা হলে কোম্পানির নানা বিষয়ে শেয়ারহোল্ডার ও গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সেসব প্রশ্নের মুখোমুখি যাতে হওয়া না লাগে, সে জন্য বিএসইসির কভিডকালীন নির্দেশনার অপপ্রয়োগ করছে কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে পুঁজিবাজারে নানা ধরনের কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে এ সুযোগ অপব্যবহার করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টিকে বিএসইসির বিধানাবলির বরখেলাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি আরও বেশ কয়েকজন আমাকে জানিয়েছেন এবং এটা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। যখন করোনা পরিস্থিতি ছিল, তখন সংক্রমণ রোধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল যারা সশরীরে থাকতে চান, তাদের জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর যারা অনলাইনে থাকতে চান তাদের জন্যও অনলাইনে সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু কোম্পানিগুলো যদি এমনটি না করে থাকে তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

সে ক্ষেত্রে নির্দেশনায় কী বলা হয়েছে তা দেখতে হবেÑউল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্দেশনাটি আমার হাতে তৈরি। তাই যতদূর মনে পড়ছে, আমরা হাইব্রিড সভা আয়োজনের কথা বলেছিলাম। তবে নির্দেশনায় যদি শুধু অনলাইনে সভা করার বিধান থাকে, তাহলে কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নির্দেশনা সংশোধন করা হবে। আর যদি হাইব্রিড ব্যবস্থার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা থাকে, তবে যেসব কোম্পানি সেটা পালন করেনি, তাদের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রকাশিত বেশিরভাগ তালিকাভুক্ত কোম্পানির এজিএম ও ইজিএমের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, কোম্পানিগুলোর এজিএম বা ইজিএম করার স্থানের জায়গায় শুধু অনলাইন বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম লেখা রয়েছে। ইতোমধ্যে সেগুলো শুধু অনলাইনেই বাস্তবায়িত হয়েছে। কোম্পানিগুলো শুধু পরিচালনা পর্ষদ ও কিছু কর্মকর্তা থাকার জন্য স্থান নির্ধারণ করে, সেখানে উপস্থিত হয়ে সভা সম্পন্ন করে। সেখানে শেয়ারহোল্ডারদের উপস্থিত থাকার কোনো সুযোগ নেই। তারা অনলাইনে উপস্থিত হয়ে সভায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাও সব কোম্পানি এ সুযোগটুকুও দিচ্ছে না।

এ বিষয়ে সশরীরে সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ চেয়ে বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী কমিশন বরাবর আবেদন করেছেন। আবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণ রোধে বিএসইসি ৮ জুলাই, ২০২০ এজিএম ও ইজিএম  সভাসহ যে কোনো ধরনের বৈঠক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আয়োজনের পরামর্শ প্রদান করেছিল। বর্তমানে করোনা মহামারির প্রভাব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ফলে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব অফিস-আদালত স্বাভাবিক নিয়মে চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট এমনকি রাজনৈতিক দলের মিছিল মিটিংও আগের ন্যায় স্বাভাবিকভাবে চলছে। বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচও আগের ন্যায় সশরীরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আয়োজিত মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী অনেকেরই মনোসংযোগ থাকে না। আবার অনেকে এক সঙ্গে একাধিক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে। অনেকে বাসায় বসে জুম অন করে পরিবারের অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। মিটিং ফি-বাবদ ব্যয় ঠিকই আগের মতো প্রদান করা হয়। কিন্তু এই মিটিংয়ে বিন্দুমাত্র কোম্পানির লাভ হয় না। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সভা, বার্ষিক সাধারণ সভাসহ সব ধরনের সভা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের পরিবর্তে সশরীরে আয়োজনের নির্দেশনা প্রদানের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি কোম্পানির বার্ষিক সভায় পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সব শেয়ারহোল্ডারের দেখা হয়। যেখানে কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আয় ও কোনো বিষয় থাকলে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন-উত্তর বা পরামর্শ করা হয়ে থাকে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে সভা করার সুযোগ দেয়ায় কোম্পানি এখনও সেটাই কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। অথচ বিএসইসির নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, সশরীরে ও অনলাইনে উভয়ভাবে সভা করতে হবে। কিন্তু কোম্পানিগুলো বিএসইসিকে ফাঁকি দিয়ে অনলাইনেই সভা করার সুযোগ নিচ্ছে। তাই বিষয়টি নজরে নিয়ে আসা উচিত। সেই সঙ্গে যেসব কোম্পানি নির্দেশনা সঠিকভাবে পরিপালন করছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে আর এরকম করতে না পারে সে বিষয়ে প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখতে হবে।

এর আগে করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শেয়ারবাজারের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনলাইনে সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কমিশন। বিএসইসির নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রভাব বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে এক জায়গায় জনসমাগমের মাধ্যমে সভা-সমাবেশ করায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। তাই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এজিএম, ইজিএম ও পরিচালনা পর্ষদ সভা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আয়োজন করার নির্দেশনা দেয়া হলো। বৈঠককালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্য সুরক্ষা যথাযথ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে কমিশনের আদেশের প্রাসঙ্গিক শর্তাবলি মেনে শেয়ারহোল্ডারদের ভোটা?ধিকার এবং অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সেসময় সারাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণকালে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর আইন করে অনলাইনে সভা-সেমিনার করার নির্দেশনা জারি করে। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার, সে আইন পরিবর্তন করে হাইব্রিড সিস্টেম চালু করে কমিশন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুনরায় করোনা সংক্রমণের প্রভাব বেড়েছে। তাই সরকারের নির্দেশনাকে প্রাধান্য দিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এজিএম, ইজিএম ও পর্ষদ সভা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০