কুষ্টিয়ায় ‘হাজল’ পদ্ধতিতে দেশি জাতের মুরগির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন ও পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন নারীরা। জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছয় গ্রামের অন্তত তিন হাজার নারী তাদের পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে দেশের পাইকারি বাজারগুলোয় দেশি মুরগি বিক্রি করছেন।
জানা গেছে, কুমারখালীর চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা, কাঞ্চনপুর, শ্যামপুর, পাইকপাড়া, ইছাখালী ও শিংদহ নিয়ে গঠিত উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাঁওতা ব্লক। এখানকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বকুল হোসেন এলাকার দুই হাজার ৮৫০ কৃষক পরিবারের নারীকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ছয়টি কৃষি পাঠাগার। তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ‘হাজল’ পদ্ধতিতে দেশি জাতের মুরগির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন ও লালন-পালনে দক্ষ করে গড়ে তোলেন তিনি।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সবার বসতবাড়ির উঠানে একটি করে মুরগির (তিনতলা) ঘর ও বসবাসরত ঘরের মধ্যে ডিম ফোটানোর জন্য এক-দুটি করে হাজল তৈরি করা হয়। এখানে প্রতি মাসে সব বাড়িতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে বাচ্চা ফুটানো হয়। এগুলো লালন-পালনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর গড়ে উৎপাদন করা হয় এক হাজার ২৬ টন দেশি জাতের মুরগি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এলাকা থেকে মুরগিগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিক্রি করে প্রতি বছর আয় করেন বিপুল অর্থ। স্থানীয়রা জানান, কাদামাটি, পাটের আঁশ, বিচালি চূর্ণ একত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে সাত ইঞ্চি গভীর, দু-তিন ইঞ্চি পুরো ও ১৩ থেকে ১৪ ইঞ্চি গোলাকার ব্যাসার্ধ পরিমাপের হাজল তৈরি করার পর রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। হাজলে মুরগি বসানোর আগে এক থেকে দুই ফোঁটা কেরোসিন তেলের সঙ্গে পরিমাণমতো ছাই মিশিয়ে মুরগিকে গোসল করানো হয়। ফলে কুচে মুরগিকে উকুনজাতীয় কোনো ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করতে পারে না। এরপর মুরগি সমষ্টির ওজনের অর্ধেক ওজনসম্মত পরিমাণের ডিম দেওয়ার উপযোগী করা হয়। কুচে মুরগি হাজলে বসানোর ২১ দিন পর বাচ্চা ফুটে বের হয়। ১২ থেকে ১৪ দিন পর মা মুরগিকে বাচ্চা থেকে আলাদা করতে হয়। এ প্রযুক্তিতে একটি দেশি মুরগি বছরে ছয়বার ডিম ও বাচ্চা উৎপাদন করে থাকে।
উপজেলার শিংদহ গ্রামের আমেনা, ফাতেমা, রোজিনা, জান্নাতুল ও সাহেলা খাতুনসহ স্বামী পরিত্যক্ত ও বিধবারা বলেন, এক মাস অন্তর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আমাদের বাড়িতে এসে মুরগি কিনে নিয়ে যান। উপার্জনক্ষম তেমন কেউ না থাকলেও এ কাজ করে আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা শেখানোসহ সংসার চলে যায় ভালোভাবেই। খাওয়া-পরার পাশাপাশি মুরগি ও ডিম বিক্রি করে দুটি ছাগল, একটা গরু কিনেছেন আমেনা।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এখানকার প্রায় ছয় গ্রাম থেকে মুরগি সংগ্রহ করে আমরা মাসে একবার ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে নিয়ে যাই। কৃষিকাজের পাশাপাশি এ ব্যবসা করে আমরা বেশ ভালোভাবেই জীবনযাপন করছি। উদ্যোক্তা বকুল হোসেন বলেন, দেশে আমিষজাতীয় খাদ্য মাংসের চাহিদা পূরণ করতে বাইরে থেকে আমদানি করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মুরগি। এগুলোকে কেমিক্যালসমৃদ্ধ খাবার খাইয়ে মাংসরূপে গড়ে তোলার কারণে মানবদেহে জটিল রোগ-ব্যাধি দেখা দেয়। তাই এ সমস্যা থেকে সমাধান পেতে কুমারখালী কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের অধীন সাঁওতা ব্লকে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশি মুরগি পালনকে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততার লক্ষ্য নিয়ে কৃষি পরিবারের নারীদের উদ্বুদ্ধ করি। এখন যেভাবে মুরগি ও ডিম উৎপাদন হচ্ছে, এভাবে সারা দেশের নারীকে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে উৎসাহ জোগাতে পারলে আমদানিনির্ভরতা থেকে রক্ষা পাবে দেশ। ভয়াবহ স্বাস্থ্যহানি থেকে রক্ষা পাবে দেশের মানবসম্পদও।
কুদরতে খোদা সবুজ