মেহেদী হাসান, রাজশাহী: কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদন ও বিপণনে দেশে শীর্ষস্থান দখল করেছে রাজশাহী। লাভবান হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে মাছ চাষের পুকুরের সংখ্যা। জেলার ৯টি উপজেলায় ৫০ হাজারের বেশি পুকুরে রয়েছে হাজার কোটি টাকার মাছ। তবে এ মাছ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মাছচাষিরা। বিশেষ করে আবহাওয়া পরিবর্তনের এ সময়ে মারা যাচ্ছে রুই, কাতল, সিলভার কার্পসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, যা আতঙ্কিত করে তুলেছে চাষিদের।
মাছচাষিরা জানান, শীত ফুরিয়ে ক্রমান্বয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। এতে মাছের খাদ্য গ্রহণ কমে গেছে। প্রতিদিনের খাদ্য বরাদ্দের তালিকা ধরে শ্রমিকরা পুকুরে একই পরিমাণ খাবার প্রয়োগ করেছেন। ফলে অতিরিক্ত খাবার পুকুরের তলদেশে জমা পড়ে তা পচতে শুরু করেছে। এ কারণে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘাটতিতে কিছু মাছ মরে ভেসে উঠছে।
এর আগে ২০২০ সালে সেপ্টেম্বরের শুরুতে এক দিনে জেলায় ৬১৬ মেট্রিক টন মাছ মরে ভেসে ওঠে, যার আনুমানিক দাম ১২ কোটি টাকা। হঠাৎ পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গত ২০ থেকে ৩০ বছরে এমন অবস্থায় পড়েননি চাষিরা। সেই একই আতঙ্ক ভর করেছে চাষিদের ওপর।
পবা উপজেলার তরক পারিলা গ্রামের মাছচাষি রাসেল আহম্মেদ বলেন, শীতে মাছে খাবার কম খায়। তারপরও খায় না এমন নয়। এবার শীত কমে হঠাৎ গরম পড়ার কারণে মাছের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক দিন ধরে মাছ খাচ্ছে না বললে চলে। আমাদের শ্রমিকরা বুঝতে পারে না। তারা খাবার দিয়ে গেছে। অতিরিক্ত খাবার তলায় জমা পড়ে পচন ধরেছে, আর মাছ মরে ভেসে উঠছে। শুধু আমার নয়, অধিকাংশ পুকুরের অবস্থা এমন।
আরেক চাষি সোহেল রানা বলেন, ‘আমি আর আমার ভাই হররা টেনে দিচ্ছি। হররা টেনে দেয়ায় নিচের গ্যাস ওপরে উঠে আসছে। তারপরও মাছ মরছে। পুকুরে চুন দিয়েছি পানি পরিষ্কারের জন্য। কিছুতে কাজ হচ্ছে না। কিছু কোম্পানির লোক আসছে, তারাই ট্রিটমেন্ট করছে। মৎস্য দপ্তরের কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। করোনার মধ্যে অনেক টাকার মাছ মারা গেছে। এবার যদি এমন হয় তাহলে আত্মহত্যা করা লাগবে।’
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব পুকুরে কাতল ও সিলভার কার্পজাতীয় মাছ বেশি চাষ করা হয়, সেসব পুকুরে অক্সিজেনের ঘাটটিতে বেশি ক্ষতি হয়। কারণ এ দুই জাতের মাছ পানির ওপরের স্তরের খাবার খায়। এ স্তরে উদ্ভিদ প্লাংটন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন তৈরি করে। এ দুই জাতের মাছ উদ্ভিদ প্লাংটন খেয়ে ফেলে। এতে অক্সিজেন তৈরির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। বর্তমানে প্রাকৃতিক খাবারের চেয়ে রেডিমেড প্যাকেটজাত কৃত্রিম খাবারের দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা। মাছ দ্রুত বড় করার জন্য ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত খাবার দিচ্ছেন। ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে।
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, জেলার সবচেয়ে বেশি মাছ উৎপাদিত হয় পবার পারিলা এলাকায়। শতকরা ৯৫ শতাংশ মানুষ মাছচাষি, বিপণনকারী ও শ্রমিক ছাড়াও বিভিন্নভাবে জড়িত রয়েছেন। প্রতিদিন ১৫০ ট্রাক মাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ অন্তত ২৫টি জেলায় যাচ্ছে। এসব মাছের দাম কমপক্ষে চার কোটি টাকা। এছাড়া জেলায় মোট পুকুরের সংখ্যা ৫০ হাজার ৭২০টি। ১১টি নদী, ৬৭টি বিল, ১৬০টি খালসহ অসংখ্য জলাভূমিতেও মাছ চাষ হচ্ছে। ২০১৭-১৮ মৌসুমে জেলায় মাছ চাষ হয়েছিল ৭৫ হাজার ২২৬ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২১-২২ বছরে ৮৫ হাজার ৩৩৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। সব বাধা-শঙ্কা উপেক্ষা করে ক্রমান্বয়ে মাছচাষ বাড়ছে বলে জানায় মৎস্য বিভাগ।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাজশাহীতে মিশ্র প্রক্রিয়ায় মাছ চাষ হয়। পুকুরে প্রধান মাছ যদি রুই হয়, তবে সিলভার কার্প, কাতলাসহ দেশি ছোট মাছও চাষ করা হয়। অনেকে পাবদা, টেংরা চাষ করেন। ফলে পুকুরে ভারসাম্য রক্ষা হয়। এখানকার চাষিরা বছরে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে মাছ চাষবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়া তারা নিয়মিত কৃষকের মাছ প্রদর্শনের মতো কর্মসূচি পালন করেন। আবহাওয়া পরিবর্তনে কিছুটা সমস্যা হতে পারে, তবে তা সাময়িক। চিন্তার কিছু নেই।