হাতের নাগালে বিদেশি সিগারেট ৭-৮ শতাংশ বাজার দখল

রহমত রহমান: দেশের বাজারে হাত বাড়ালে মিলছে বিদেশি সিগারেট। অরিস, ইজি স্পেশাল গোল্ড, মন্ড, স্ট্রবেরি, ভন ইন্টারন্যাশনাল, ৫৫৫, ৩০৩, উইনস্টোন, গ্র্যান্ড-২০০০, ইজি অউরা, ব্ল্যাক, মালবোরো, উলসন ল্যান্ড এম, ত্রি জিরো ত্রি, মডার্ন, ডাবল হ্যাপিনেস, ডানহিলসহ বাহারি নামের এসব সিগারেটকে বিক্রেতারা নাম দিয়েছেন ‘বিলাসী’ সিগারেট। একসময় বিমানবন্দর ও কিছু অভিজাত এলাকায় মিলত এই সিগারেট। অনেকে শখের বশে বিদেশ থেকে নিয়ে আসতেন। কিন্তু বর্তমানে শহর থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় হাতের নাগালে রয়েছে এ সিগারেট। এসব সিগারেট আমদানি হয় না। তাহলে এসব সিগারেট দেশের বাজারে আসছে কীভাবে? হিসাব অনুযায়ী, দেশের বর্তমান সিগারেট বাজারের ৭-৮ শতাংশ বাজার দখল করেছে এ সিগারেট। এ সিগারেট থেকে কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সঙ্গে দেশের অন্য সিগারেট কোম্পানিও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে এ সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়েছে এনবিআর।

এনবিআর সূত্রমতে, স্থানীয় বাজারে অবৈধ বিদেশি সিগারেটের সহজলভ্যতা ও সরবরাহ বন্ধের প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে এনবিআর থেকে সব ভ্যাট কমিশনারকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ২৮ মার্চ দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে বলে এনবিআর জানতে পেরেছে। সিগারেটের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক বছরে বিদেশি কোনো সিগারেট বৈধভাবে আমদানি হয়নি। এরপরও ঢাকাসহ সব জেলা, উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাজারেও এসব বিদেশি সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য, বিদেশি সিগারেটগুলো স্থানীয় সিগারেটের ‘প্রিমিয়াম স্তর ও উচ্চস্তর’ সিগারেটের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে। দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় ধূমপায়ীরা বিদেশি সিগারেটগুলোকে ‘প্রিমিয়াম স্তর ও উচ্চস্তর’ এর পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করছেন। আইন ও বিধি না মেনে আনীত সব সিগারেট বাজারজাতকরণের ফলে আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

আরও বলা হয়েছে, কাস্টমস আইন, আমদানি নীতি আদেশের বিধান লঙ্ঘন করে বিদেশি সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বাজারজাত ও বিক্রয় করা চোরাচালান হিসেবে গণ্য এবং আইনগত দণ্ডনীয় অপরাধ। এছাড়া ব্যান্ডরোল বিহীন কিংবা জাল ব্যান্ডরোলযুক্ত সিগারেট-বিড়ি তৈরি, মজুত, সরবরাহ, বিক্রয় ও ব্যবহার দণ্ডণীয় অপরাধ। সে জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সিগারেট খাতে সরকারের রাজস্ব সুরক্ষার জন্য অবৈধ বিদেশি সিগারেটের আমদানি, সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ বন্ধে অভিযান এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা এনবিআরকে অবহিত করার অনুরোধ হয়।

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তারা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, এনবিআর সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকের কর নির্ধারণ করে। সঠিকভাবে কর আদায় হচ্ছে কি না তা তদারকি করে। কিন্তু তামাকের বাজার তদারকি, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, অভিযান পরিচালনা করা এনবিআরের কাজ নয়। তদারকির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার, জেলা প্রশাসন রয়েছে। এছাড়া চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্সও রয়েছে। সে জন্য অবৈধভাবে বাজারে সরবরাহ, বিক্রি, মজুত করা এসব সিগারেট নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্সের সহায়তা চাইবে এনবিআর। এনবিআর থেকে সহসা মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে একটি আধা-সরকারি পত্র (ডিও লেটার) চিঠি দেয়া হবে। তাতে স্থানীয় পর্যায়ে সিগারেট খাতে রাজস্ব সুরক্ষার লক্ষ্যে অবৈধ বিদেশি সিগারেটের আমদানি, সরবরাহ ও বাজারজাত বন্ধে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে চোরাচালান নিরোধ টাস্কফোর্সের আওতায় সুনির্দিষ্ট তথ্য বা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনাসহ কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হবে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভোক্তা অধিকার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অভিযান পরিচালনা করলে কিছুটা হলেও বাজারে প্রভাব পড়বে। কারণ, বিশাল সাপ্লাই চেইন না থাকলে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে এ সিগারেট পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয়। একই সঙ্গে কাস্টমসকে আরও তদারকি বাড়াতে এনবিআর নির্দেশনা দেবে। তবে কারা, কীভাবে এই সিগারেট আমদানি করে, না কি দেশে উৎপাদন হচ্ছেÑতা গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানোর উদ্যোগ নেবে এনবিআর।

লাগেজে কিছু বিদেশি সিগারেট আসত। সেই সিগারেট বিমানবন্দর ও অভিজাত কিছু এলাকায় পাওয়া যেত। আর মাঝে মধ্যে কনটেইনারে লুকিয়ে কিছু সিগারেট আমদানি করা হতে। তবে তা খুবই নগণ্য। কিন্তু গত কয়েক বছরে অবৈধ এসব সিগারেট শহর থেকে গ্রামে পৌঁছে গেছে। এসব সিগারেটের বাজার কত তার কোনো হিসাব নেই এনবিআরের কাছে। তবে প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে, যেসব দোকানে খুচরা সিগারেট বিক্রি হয়, সেই দোকানে পাঁচ প্যাকেট দেশীয় সিগারেট (বিএটি, জেটিআই ও দেশীয় কোম্পানি) এক প্যাকেট বিদেশি সিগারেট পাওয়া যায়। কম নিকোটিন, সুগন্ধযুক্ত, কম দাম হওয়ায় এ সিগারেটের বাজার বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণরা এই সিগারেটে বেশি ঝুঁকছে। এনবিআর ধারণা করছে, মোট সিগারেট বাজারের ৭-৮ শতাংশ এ সিগারেটের দখলে চলে গেছে।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর প্রিমিয়াম স্তরের প্রতি ১০ শলাকা সিগারেট থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা। সে হিসেবে একটি সিগারেট থেকে রাজস্ব পায় ১২ টাকা ১৫ পয়সা। আর বাজারে বিক্রি হওয়ায় অবৈধ এসব সিগারেটকে প্রিমিয়াম বা উচ্চস্তরের পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করছে ভোক্তারা। তবে এসব সিগারেট থেকে কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না এনবিআর। দেশের মোট সিগারেট বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দখলে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বছরে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক দেয় প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। অবৈধ সিগারেট বাজারের ৭-৮ শতাংশ। সে হিসেবে অবৈধ এসব সিগারেট থেকে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

অনুসন্ধান বলছে, বাংলাদেশের বাজারে সাধারণত ইউএসের ৩০৩, কোরিয়ান ইজি, ব্ল্যাক, ডানহিল, ৫৫৫, সুপার সিøম, লাক্সারি ফিল্টার্স, আমেরিকার ব্লেন্ড, স্ট্রবেরি, জাভা ব্র্যান্ডের সিগারেটগুলো অবৈধভাবে বেশি আসছে। এসব সিগারেট কাতারের দোহা, আরব আমিরাতের দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও চীন থেকে অবৈধভাবে আনা হচ্ছে। জাহাজে করে আসা সিগারেট চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্র বন্দর ও খুলনার আংটি হারায় খালাস হয়ে দেশে ঢুকছে। এছাড়া কনটেইনারে বিশেষ করে শতভাগ রপ্তানিমুখী কিছু প্রতিষ্ঠানের কনটেইনারে করে আমদানি হচ্ছে। তবে বান্দরবান পাহাড়ি এলাকায় এসব সিগারেট তৈরি হচ্ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। একটি শক্তিশালী চক্র এ সিগারেট আমদানির পর বাজারে পৌঁছে দিচ্ছে। ‘ছবিযুক্ত সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা’ এবং ‘রাজস্ব স্ট্যাম্প’ বিহীন এসব সিগারেট বিক্রিতে খুচরা বিক্রেতারা বেশি লাভবান হচ্ছেন।

অন্যদিকে, ঢাকার একাধিক খুচরা সিগারেট বিক্রয় করা দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি দোকানে কমবেশি এসব সিগারেট রয়েছে। বিক্রেতারা এই সিগারেটকে বিলাসী সিগারেট আখ্যা দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, একটা শ্রেণির মানুষ অনেকটা বিলাসীতা করে এ সিগারেট খায়। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে তাদের কাছে এই সিগারেট পৌঁছে দেয় একটি চক্র। রাজস্ব দিতে হয় না বলে কিছুটা কম দামে খুচরা বিক্রেতারা এই সিগারেট কিনতে পারেন। তবে প্রতি প্যাকেটে ভালোই লাভ থাকে বিধায় তারাও বিক্রি করতে আগ্রহী। তবে কারা এই সিগারেট পৌঁছে দেয়, কোথায় মজুত থাকেÑএসব বিষয়ে খুচরা বিক্রেতারা মুখ খুলছে নারাজ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০