শেয়ার বিজ ডেস্ক: নীলফামারীর ওপর দিয়ে বয়ে চলা একসময়ের প্রমত্তা বুড়িখোড়া নদী পরিণত হয়েছে সরু খালে। খনন না করায় এবং প্রভাবশালীদের দখল-দূষণে অনেকটাই মরে গেছে নদীটি। এখন নদীগর্ভে চলছে ফসলের চাষাবাদ। যেটুকু অবশিষ্ট সরু খাল রয়েছে, তা দিয়ে কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যমিশ্রিত পানি প্রবাহিত হওয়ায় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। দেশি জাতের মাছগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
এভাবে জেলার ২৪টি নদ-নদী দখল-দূষণে মরে যাচ্ছে। অধিকাংশ নদীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে জেগেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। সেসব চর এখন আবাদি জমি। কোনো কোনো নদী এখন ধানক্ষেত। এই বেহাল দশা দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি একসময় নদী ছিল। পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে যেটুকু চিহ্ন আছে, তা অনেকে দখল করে নিয়েছে। দুই পাশ দখল করে গড়ে তুলেছে অবকাঠামো।
বেসরকারি সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলার ছয় উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীর সংখ্যা ৩৪টি। একসময় বছরজুড়ে পানিতে থই-থই করত। এখন প্রায় সবই মৃত।
তবে নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, জেলায় নদ-নদী আছে ২৪টি, যার পরিমাণ এক হাজার ৪৪০ কিলোমিটার। কিছু নদ-নদী দখল-দূষণের কবলে পড়েছে। সেগুলো খনন করা হবে।
জেলার নদীগুলো হলে তিস্তা, বুড়ি তিস্তা, যমুনেশ্বরী, চাকলা, খড়খড়িয়া, দেওনাই, চারালকাটা, চারা, বুড়িখোড়া, ধুম, বামনডাঙ্গা, পাঙ্গা, কুমলাল, নাউতারা, ইছামতী, কলমদার, বুল্লাই, শালকি, খেরকাটি, খেড়য়া, চিকলি, চেকাডারা, আউলিয়াখানা, ধাইজানসহ ২৪টি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এসব নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় প্রভাবশালীরা দখল করে চীনাবাদাম, কুমড়া, ভুট্টা, ধান চাষ, মাছের পুকুর, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সেতুবিহীন কাঁচা-পাকা সড়ক তৈরি করেছে। প্রতিনিয়ত দখল করার ফলে নদীর উপকারিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয়ারা বলছেন, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ না থাকায় দখল ও দূষণের কবলে পড়ে নাব্য হারিয়েছে নদ-নদীগুলো। বিশেষ করে স্থাপনা নির্মাণ ও চাষাবাদের জন্য নদী দখলের উৎসব চলছে।
জেলা সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালীপাড়া গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িখোড়া নদী। এর উৎপত্তিস্থল ডোমার উপজেলার কলামদার গ্রামে। দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার, প্রস্থ ২৬ ফুট। এই নদীর বুদারুর ঘাট, কদমতলী, হরহরিয়ার ঘাট ও সন্ন্যাসীর ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, ভুট্টা ও বোরো ধান চাষ করা হয়েছে।
বুদারুর ঘাট এলাকার কৃষক রমেশ চন্দ্র রায় (৬৮) ও বিশ্বনাথ রায় (৭০) জানিয়েছেন, সন্ন্যাসীর ঘাট, কদমতলী ও বুদারুর ঘাট দিয়ে একসময় চলত ডিঙি নৌকা ও ট্রলার। এসব নৌযানে বাণিজ্য করতে আসতেন দেশ-বিদেশের সওদাগররা। এখন সেসব ইতিহাস। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় পানি শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় গ্রামের মানুষজন ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া ও বোরো ধানের চাষ করছেন। আবার সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় বাড়িঘর। এই এলাকায় এখন কোনো নদী নেই, যা ছিল তা ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে।
ডোমার উপজেলার কেতকিবাড়ি গ্রাম থেকে যমুনেশ্বরী নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে গোমনাতি, বামনিয়া, বোড়াগাড়ী, মটুকপুর ও ধর্মপাল হয়ে চলে গেছে দক্ষিণে। এর দৈর্ঘ্য ৬০ কিলোমিটার ও প্রস্থ ছিল ৫৫ ফুট। বর্তমানে নদীর বুকে ধান মাড়াইয়ের চাতাল তৈরি করেছেন স্থানীয় কৃষকরা।
নদীগুলো খনন করা হলেও তা কৃষকের কাজে আসছে না বলে জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। নদীর দুপাশে যাদের জমি, তারাই দখল করে স্থাপনা তৈরি করছেন।’
ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেশ্বর স্থানে উৎপত্তি হয় কুমলাল নদীর। এই এলাকার বাসিন্দা শাহের আলী (৬৩) নদী ভরাট করে শুটিবাড়ী বাজারে পাঁচটি দোকান করেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার দোকানগুলো নদীর ওপর। সামনের মহিলা মার্কেটও। এখন আর নদী তো নেই, শুকিয়ে গেছে। কারও কোনো কাজে আসছে না। এজন্য সবাই ঘরবাড়ি, দোকানপাট তৈরি করছেন। তাই আমি করেছি।’
একই এলাকার ছাবের আলী (৬৮), আব্দুর রহমান (৭০) জানান, গয়াবাড়ী আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি কুমলাল নদী ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে। অল্প কিছুদিন আগে নির্মাণ করা হয়েছিল।
নদ-নদী দখল করে স্থাপনা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, ‘ছোট-বড় মিলিয়ে জেলায় এক হাজার ৪৪০ কিলোমিটার নদ-নদী আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসব নদীর শতকরা ৬৫-৭০ শতাংশ খনন করা হয়েছে। এ কারণে গত বন্যায় প্রভাব পড়েনি মানুষের জানমালের ওপর। যারা নদ-নদী দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে, তাদের উচ্ছেদ করা হবে।’
রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ওয়াদুদুর রহমান (তুহিন ওয়াদুদ) বলেন, ‘নদীখেকোদের কারণে নীলফামারীর সব নদ-নদী মৃত্যুর মুখে। এগুলোর ওপর করা হয়েছে ভয়াবহ নির্যাতন। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট দেশের সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন। এতে নদীকে হত্যা করা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও গণ্য করা হয়। তিস্তা নদীর আন্তঃশাখা এই নদীর দৈর্ঘ্য ২৫ কিলোমিটার। খালিশা চাপানি ও টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব খড়িবাড়ী ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা নদীতে আবার মিলিত হতো। এখনও সব দখল হয়ে গেছে। এগুলো উদ্ধারে কোনো ভূমিকা নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের।’
কুমলাল নদীতে ২৭০ অবৈধ দখলদার রয়েছে বলে জানিয়ে তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘তাদের স্থাপনা উচ্ছেদ, সীমানা চিহ্নিতকরণ, নদীর পুরোনো প্রবাহপথ সচল করা, খাজনা-খারিজ, ক্রয়-বিক্রয় ও রেকর্ডভুক্ত করার কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।’