হারিয়ে যাচ্ছে চৌগাছার মৃৎশিল্প

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: কালের আবর্তে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে যশোরের চৌগাছা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে চোখে পড়ার মতো বসবাস ছিল পাল সম্প্রদায়ের মানুষের। আধুনিকতার ছোঁয়া ও কালের পরিক্রমায় এ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পাল সম্প্রদায়ের এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার অনেক কষ্টে তাদের পূর্বপুরুষের এ পোশাকে ধরে রেখেছে। এতে করে পুরো চৌগাছার মৃৎশিল্প এখন মৃতপ্রায়।

উপজেলার ইছাপুর, নিয়ামতপুর, হাকিমপুর, তাহেরপুর, হাজরাখানা, সাঞ্চাডাঙ্গা, কয়ারপাড়া, গরিবপুর, পলুয়া, ধুলিয়ানী ও গয়ড়া গ্রামে চোখে পড়ার মতো বসবাস ছিল পাল সম্প্রদায়ের মানুষের। মাটির তৈরি নানা ধরনের সামগ্রী তৈরির পর তা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। দিন কিংবা রাত সারাক্ষণই তাদের কাঁদা মাটি নিয়েই ছিল কাজ। হাতের নিপুণ কারুকাজের মাধ্যমে তার তৈরি করত রিং, কলস, ভাড়, হাড়ি-পাতিল, নান্দা, সরা, মালসা, খোলা, পুতুল, ফুলের টব, ঘট, দইয়ের খুরিসহ হরেক করমের সামগ্রী। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাটির তৈরি সামগ্রী আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। কেননা, প্লাস্টিকের তৈরি সামগ্রী এখন মানুষের কাছে অতি প্রিয় হয়ে উঠেছে। বাজারে মাটির তৈরি সামগ্রীর আগের মতো চাহিদা না থাকায় লোকসান গুনতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছে। এদের মধ্যে কেউ কৃষি কাজ বেছে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ সাধারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায় শুরু করেছেন। যারা আজও বাপ-দাদার রেখে যাওয়া পেশাকে আগলে রেখেছেন তারা কোনো রকমে এ পেশায় জীবিকা চালাচ্ছে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকার পালপাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে সরেজমিনে কথা হয়েছে। তারা যে ভালো নেই এমনটিই জানালেন মৃৎ শিল্পীরা।

সম্প্রতি পৌর এলাকার ইছাপুর পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, হাতে গোনা ৭/৮ ঘর মানুষ মাটির তৈরি সামগ্রী আজও তৈরি করছেন। অন্য কোনো পেশার কাজে তারা দক্ষ নয়। তাই পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এ পেশাকে তারা আজও আগলে রেখেছেন। এ সময় কথা হয় পালপাড়ার মৃত গোবিন্দ পালের ছেলে ব্রজেশ্বর পালের সঙ্গে। তিনি জানান, ইছাপুর পালপাড়ায় এক সময় প্রতিটি পরিবার মাটির তৈরি সামগ্রী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজার দরের কাছে এ পেশায় যা রোজগার হয়Ñতা দিয়ে সংসার চালানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। সে কারণে অনেকেই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র।

বর্তমানে গ্রামটিতে ব্রজেশ্বর পাল, গরুর পাল, শামন্ত পাল ও অজিত পাল তৈরি করে চলেছেন মাটির সামগ্রী। পালপাড়ার ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সমানতালে কাজ করেন। স্বামী তৈরি করছেন মাটির হাড়ি বা কলস। অন্যদিকে স্ত্রী তৈরি করছেন দই এর ঘুরি, খোলা বা সরা। আবার স্বামী-স্ত্রী উভয়ই মিলে তৈরি করছেন নানা সামগ্রী।

গৃহবধূ লাবণী পাল ও শিবা পাল জানান, বাজারে এমনিতেই মাটির সামগ্রীর চাহিদা কম, তারপর যদি স্বামী একাকী কাজ করেন তখন খুব বেশি মালামাল তৈরি করতে পারে না। উভয়ে মিলে এক সঙ্গে কাজ করলে বেশি সামগ্রী তৈরি করা যায়। সে কারণে সংসারের কাজের পাশাপাশি স্বামীর কাজেও আমরা সহযোগিতা করি। প্রভাত পাল জানান, আমরা পরিশ্রম করে যে সব মালামাল তৈরি করি তার যদি ন্যায্য মূল্য পেতাম তাহলে সমস্যা ছিল না, আমরা বরাবরই পণ্যের সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হই। তারপরও কিছু করতে পারি না, সেজন্য লাভ লোকসানের হিসাব না করে কাজ করে যাই। বছরের ১২ মাসই কম বেশি কাজ হয়, তবে শীত মৌসুম এলে কাজ কিছুটা বাড়ে। অন্য মাসের লোকসান মূলত শীতে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি।

মৃৎশিল্পীরা জানান, তাদের তৈরি সামগ্রী ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর, খালিশপুর, রাজশাহী ও নাটোরের ব্যবসায়ীরা এসে পাইকারি কিনে নিয়ে যায়। আমরা যে দরে মালামাল বিক্রি করি তার থেকে অনেক বেশি দরে ওই সব ব্যবসায়ী বিক্রি করেন। বলা চলে আমাদের থেকে ব্যবসায়ীরা বেশি লাভবান হয়।

উপজেলার সচেতন মহল মনে করেন, এ শিল্প বাঙালি জাতির জন্য গৌরব ও অহংকার। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনই সরকারি সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করে মাটির জিনিসপত্রের প্রয়োজনীয়তা সবার কাছে তুলে ধরা দরকার। তা না করা হলে মৃৎশিল্পীদের স্থান হবে শুধু ইতিহাসের পাতায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০