হারিয়ে যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের ‘এসিঘর’

মেহেদী হাসান, রাজশাহী : দশক দুই আগে পুকুরের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকত দোতলা বাড়ি। এখনকার মতো ইট-পাথরের কিংবা চুন-সুরকির অট্টালিকা নয়, সোঁদা মাটির দালান। রাজশাহীর নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, বগুড়াসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রতিটি জেলায় ইউনিয়নেই শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের ছিল এ মাটির ঘর। তবে দ্রুতই বিলুপ্ত হচ্ছে ‘গরিবের রাজপ্রসাদ’-খ্যাত মাটির ঘর, অনেকে যাকে বরেন্দ্রের ‘এসিঘর’ হিসেবেও ডাকত!

জানা যায়, মাটি, খড় ও পানি ভিজিয়ে কাদায় পরিণত করে ২০ থেকে ৩০ ইঞ্চি চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হতো। দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড়কুটা অথবা ঢেউটিনের ছাউনি দেয়া হতো। আবার অনেক সময় দোতলা পর্যন্তও করা হতো এই মাটি দিয়েই। মাটির দেয়ালেই গৃহিণীরা বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। এভাবে নির্মিত হয় মাটির ঘর।

বরেন্দ্র অঞ্চলে শখের বশে কিংবা সামাজিক মর্যাদার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মাটির দোতলা বাড়ি। প্রভাব বিস্তার অথবা জোতদার হিসেবে জাহির করতেও অনেকে গড়ে তুলেছিলেন বড় বড় মাটির প্রাসাদ। নতুন দশক শুরুর পর থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিচরণ মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পারিবারিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে মানুষ এখন আর মাটির ঘরে থাকতে চায় না। প্রাচীনতম আড়মোড়া ভেঙে আধুনিক যুগে প্রবেশ করছে গ্রামের মানুষ।

সমাজবিজ্ঞানী ও সংস্কৃতিকর্মীরা বিষয়টাকে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ও মানুষের আয় বৃদ্ধিকে প্রধান হিসেবে দায়ী করছেন। তারা মনে করছেন, সরকারি পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকসহ বিভিন্ন এনজিওর ঋণ প্রদানের কারণে এ অঞ্চলের কায়িক পরিশ্রম করা নি¤œআয়ের পরিবারগুলো এখন তৈরি করছে ছোট আকারের দালান। নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের ততটা সামর্থ্য না থাকলেও অন্ততপক্ষে টিনের বেড়া আর টিনের চালা দিয়েও হলেও বানাচ্ছে ঝকঝকে সুন্দর ঘরবাড়ি।

আবার দীর্ঘস্থায়ীভাবে অনেক লোকের নিবাসকল্পে ইট, বালু আর সিমেন্টের ব্যবহারে দালানকোঠা-অট্টালিকার কাছে হার মানছে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি এ রাজপ্রসাদটি।

রাজশাহী তানোর উপজেলার মুণ্ডমালা বাধাইড় এলাকার বারিউল ইসলাম বলেন, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মাটির ঘরে বসবাস করে আসছে। শীত বা গরমে থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক। মাটির ঘরে শীতের দিনে ঘর থাকে উষ্ণ, আর গরমের দিনে শীতল। তাই মাটির ঘরকে ‘গরিবের বালাখানা’ বলে থাকি।

মাটির তৈরি বাড়িতে কেন এত আগ্রহ ছিলÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম লাগত। তবে এসব মাটির ঘর তৈরি করতে সময় লাগত দেড় থেকে দুই মাস। কিন্তু বর্তমানে এর চাহিদা না থাকায় কারিগররাও এ পেশা ছেড়ে অন্য অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। মূলত খরচ কম হওয়া ও লোকবল কম লাগার কারণে আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিল।

মাটির ঘর ছেড়ে দালান-কোঠার ঘর বেঁধেছেন স্কুলশিক্ষক আজিজুল হক। তিনি বলেন, মাটির ঘরে কিছু সুবিধা আছে। ঠাণ্ডার সময় গরম আর গরমের সময় ঠাণ্ডা। তবে মাটির ঘরে অনেক ইঁদুর গর্ত করে, যেখানে সাপের উপদ্রব হয়। সেখানে অনেক ভয়-ভীতির মধ্যে থাকতে হয়, যার কারণে মাটির বাড়ি ভেঙে দালান-কোঠা দিয়েছি। এখন বেশ আরামেই আছি।

বরেন্দ্র অঞ্চলের বেশ কিছু লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, আরামদায়ক মাটির ঘরে দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানরাও একসময় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। এঁটেল ও দো-আঁশ মাটি দিয়ে কম খরচে খুব সহজেই তৈরি করা হয়েছে এ ঘর। মাটির দেয়াল তৈরি সম্পূর্ণ হলে তার ওপর খড়ের ছাউনি অথবা মাটির তৈরি টালি ছাউনি দেয়া হয়েছে। বৃষ্টি বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এসব ঘর অনেক বছর পর্যন্ত টিকে থাকত। আর বর্তমানে মানুষের আধুনিক জীবনযাপনের ইচ্ছা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সবাই মাটির ঘর ভেঙে টিন আর ইটের পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন।

বাধাইড় ইউপি চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান জানান, মানুষের আধুনিক জীবনযাপনের ইচ্ছা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সবাই মাটির ঘর ভেঙে টিন আর ইটের পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন। তবে এ অঞ্চলের গ্রামগুলোয় এখনও কিছু মাটির বাড়ি লক্ষ করা যায়। এখন দীর্ঘস্থায়ীভাবে বেশি মানুষের বসবাসের জন্য পাকা বাড়ি বানানো হচ্ছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০