আলী ওসমান শেফায়েত: হিজড়া আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাতের এক অনন্য মানব সম্প্রদায়। এ মানব সম্প্র্রদায় সম্পর্কে আমাদের মন-মগজে এক ভিন্ন নেতিবাচক বদ্ধ ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। ফলে সমাজে অতি কাছে থেকেও হিজড়াদের সম্পর্কে আমাদের দায়িত্ববোধের অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
প্রতিবন্ধী মানুষের যেমন শারীরিক ত্রুটি থাকে এটি তেমনই একটি ত্রুটি। তবে এই ত্রুটির জন্য তাদের মানবসমাজ থেকে বের করে দেয়া ঠিক না। বরং অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতো তারা আরও বেশি স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখে।
হিজড়াদের প্রতি ঘৃণা নয়, ভালোবাসা-স্নেহ এবং গুরুত্ববোধ দরকার। গুরুত্বহীনতায় সমাজের যে কোনো মানুষ ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্নবাদীতে পরিণত হয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
হিজড়া বলতে সাধারণত তৃতীয় লিঙ্গকেই বোঝানো হয় এবং বাংলাদেশে সর্বত্র হিজড়াদের বিশেষ করে শহরাঞ্চলে হিজড়াদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তাছাড়া রাজধানী শহর ঢাকাতে হিজড়াদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তবে বর্তমানে ছোট শহর এবং উপশহরেও হিজড়াদের ব্যাপক আনাগোনা চোখে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে হিজড়ারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং শোচনীয় জীবনাচরণে অভ্যস্ত থাকে। যেখানে মানবাধিকারের কোনো বালাই নেই, অর্থাৎ মানুষ হিসেবে জš§গত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, হিজড়ারা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকার প্রদত্ত হিজড়াপল্লীতে বসবাস করে অথবা নিজেদের উদ্যোগে ভাড়াকৃতভাবে তৈরিকৃত কোনো আবাসস্থলে। আবার অনেক সময় এও দেখা যায়, বাড়িওয়ালারা সহজে হিজড়াদের বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। তাই, স্বাভাবিকভাবে যেসব জায়গা ভাড়ার অনুপযুক্ত সেই সব নোংরা পরিবেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় হিজড়া সম্প্র্রদায়ের।
যেহেতু তারা সমাজ কিংবা রাষ্ট্র থেকে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথাযথ সুবিধা পায় না, কাজেই জীবনধারণের জন্য অদ্ভুত সব পন্থা অবলম্বন করে যার প্রেক্ষিতে জনজীবনে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। যদিও বিষয়গুলো অসামাজিক, রুচিহীন, শালীনতাবিরোধী। তথাপি জীবনধারণের জন্য হিজড়াদের ব্যতিক্রম কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কারণ আবাসিক বাড়িতে হিজড়াদের কাজ দেয়া হয় না, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হিজড়াদের জন্য কর্মস্থল খালি থাকে না। তাহলে তারা টিকে থাকবে কীভাবে? বেঁচে থাকার জন্যই জনজীবনে অস্বস্তিমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে হিজড়ারা। আবার এও সত্য, অনেক হিজড়াদের মাঝে মধ্যে কাজের সুযোগ আসা সত্ত্বেও তারা তাদের যাপিত পেশা থেকে সরে যেতে পারছে না। পাশাপাশি, জনজীবনে অস্থির পরিবেশ তৈরি করার কারণে সমাজে হিজড়াদের সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকে। অধিকন্তু একটি গ্রুপ কিংবা বিশেষ মহল হিজড়াদের উদ্দেশ্য করে কপাট কিংবা নেতিবাচক মন্তব্য ছুঁড়ে থাকে সর্বদাই।
বাংলাদেশে হিজড়াদের সাম্প্র্রতিক অবস্থা অত্যন্ত নড়বড়ে। যদিও সরকারসহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ হিজড়াদের বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে তথাপি হিজড়াদের কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই। সামাজিকভাবে হিজড়াদের কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় না, ঠিক তেমনি সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে হিজড়াদের দাওয়াত দেয়া হয় না। হিজড়াদের সামাজিক অবস্থা দলিতদের (অস্পৃশ্য) থেকেও নগণ্য অবস্থায় বিরাজ করছে। হিজড়াদের সঙ্গে তাদের পিতামাতারাও কোনো সামাজিক সম্পর্ক পর্যন্ত রাখে না। তাই সামাজিকভাবে হিজড়ারা অনেকটা একঘরে হয়ে যায় পারতপক্ষে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত হিজড়াপল্লীতে তথা নিজেরা একত্রিত হয়ে বাঁচার সংগ্রামে ব্যস্ত থাকে। হিজড়াদের কেউ অপমান অপদস্থ করলেও সমাজের কোনো বিবেকবান তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় না। উল্টো হিজড়াদের কটাক্ষ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, সমাজের একটি শ্রেণি হিজড়াদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে না।
হিজড়ারা কেন সামাজিক অস্বস্তিজনক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে? অনুসন্ধান করলে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দু’ধরনের কারণই বের হয়ে আসে। বেঁচে থাকাই যেখানে দুঃসাধ্য সেখানে নিয়মের অনিয়ম হবে এটাই স্বাভাবিক। কোনো মানুষই অপরাধী হয়ে পৃথিবীতে জš§ায় না। পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং সামাজিক বাস্তবতা মানুষকে অপরাধের দিকে ধাবিত করে থাকে। হিজড়ারাও তার ব্যতিক্রম নয়। সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে হিজড়াদের নানামুখী সমাজবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত হতে হচ্ছে। কারণ, বেঁচে থাকাই যেখানে মুখ্য বিষয় অন্যান্য কিছু সেখানে গৌণ। তাদের জন্য সামাজিকভাবে কোনো কাজের ব্যবস্থা হচ্ছে না। তাহলে তারা কীভাবে টিকে থাকবে? টিকে থাকার তাগিদেই হিজড়াদের জনজীবনে অস্বস্তিমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। সুতরাং হিজড়াদের জীবনাচরণ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সামাজিকভাবে গবেষণা করার বিশদ প্রয়োজন রয়েছে। যদি কোনোভাবে তাদের যথাযথভাবে পুনর্বাসন করা যায়, তাহলে হিজড়াদেরও উন্নয়নশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে। কেননা, তারা তো ইচ্ছা করে হিজড়া হয়ে জš§গ্রহণ করেননি, বাস্তবতার নির্মম সত্যের কারণেই তার আজ হিজড়া। এতে তাদের কোনো হাত নেই। কাজেই তাদের কোনোভাবেই অমর্যাদা তথা অবমূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। হিজড়াদের মানোন্নয়নে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশকিছু পদক্ষেপ ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, হিজড়ারা সাধারণত অযাচিতভাবে শরীরে হাত দেয়া, জোরপূর্বক টাকা আদায়, অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন, শরীরের ওপর পরে যাওয়া, নতুন জš§ নেয়া শিশুর জন্য টাকা আদায়, বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে টাকা আদায়, দোকান থেকে টাকা আদায়, রেস্টুরেন্ট থেকে টাকা আদায়, গাড়ির জানালা দিয়ে টাকা গ্রহণ, এটিএম বুথের বাইরে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায়, ধমক দিয়ে টাকা আদায়, উলঙ্গ হয়ে কিংবা শরীরের কোনো অংশের কাপড় তুলে টাকা আদায় ইত্যাদি কর্মের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকে। বেশ কয়েক মাস ধরে ঢাকা শহরে থাকায় প্রায়ই পাবলিক বাসে হিজড়াদের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
আবার টাকা উত্তোলনের সময় হিজড়ারাও যে অত্যাচারের শিকার হয় না বিষয়টা এমন নয়। মাঝে মধ্যে দেখা যায়, টাকা উত্তোলনের সময় হিজড়া সম্প্রদায় অত্যাচারের শিকার হয়। তথাপি হিজড়াদের রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসে না। ঘটনার পরম্পরায় কয়েকজন হিজড়া একসঙ্গে হয়ে এবং ঘটনাস্থলে পুলিশের সহায়তায় ধর্তব্য বিষয়ের মীমাংসা করতে হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হিজড়ারা যেমন সামাজিকভাবে অস্বস্তিুর সৃষ্টি করে ঠিক তেমনি তারাও শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে থাকে। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে প্রতিপক্ষ মনে করে থাকে। এক পক্ষে সাধারণ জনতা ও অন্য পক্ষে হিজড়া সম্প্র্রদায়। এ ধরনের অমূলক চিন্তাভাবনা দূর করে হিজড়াদের মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসা উচিত সমাজের স্বার্থেই বিশেষ করে সামাজিক অবক্ষয় নিরসনে।
হিজড়ারা সামাজিক অস্বস্তিমূলক যেসব কর্ম করে থাকে তার থেকে পরিত্রাণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ছে। পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে ক্ষান্ত না হয়ে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে হিজড়াদের সামাজিক বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা যাবে।
পদক্ষেপগুলি হচ্ছেÑ
# হিজড়াদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ প্রদান করা,
# অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা,
# নাগরিক হিসেবে মানবাধিকার নিশ্চিত করা,
# জনগণের মধ্যে হিজড়াদের নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। অর্থাৎ হিজড়ারা যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ পায় তাহলে হিজড়াদের দ্বারা সংগঠিত এহেন ঘৃণিত কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হবে।
# হিজড়াদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে।
# উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য।
# সরকার প্রদত্ত সব ধরনের সামাজিক সুযোগসুবিধা হিজড়াদের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে।
# কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী দেশে মোট হিজড়ার সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের মতো। সুতরাং তাদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে জনমনে হিজড়া নিয়ে যে অস্বস্তি রয়েছে তা আর থাকবে না। বর্তমান সরকার হিজড়াদের মানোন্নয়নে বেশকিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন হলে সুফল দেখতে পারব আমরা। তবে এ বিষয়ে হিজড়া সম্প্রদায়ের দায়ও কোনো অংশে কম নয়। তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সুবিধাগুলো গ্রহণ করার মাধ্যমে নিজেদের যথার্থতাকে সমাজের মধ্যে তুলে ধরতে হবে। তাহলেও জনজীবনে হিজড়া সম্প্রদায় কর্তৃক আহূত অস্বস্তিগুলো অচিরেই দূরীভূত হয়ে যাবে।
শিক্ষক ও মুক্ত লেখক
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার