Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 10:29 pm

হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল সংঘাত ও লেবাননের ভবিষ্যৎ

মোহাম্মদ আব্দুর রহমান: বিশ্ব রাজনীতিতে একটি দেশকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে হলে তার ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ ভূমিকা রাখে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে, যে দেশগুলোর মধ্যে লেবানন অন্যতম। লেবাননের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে হওয়ায় দেশটির আকারের তুলনায় এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে হারানো প্রভাব ফিরে পেতে ফ্রান্স যেমন লেবাননে তার অবস্থানকে শক্ত করতে চাইছে, তেমনি ইরান ও সৌদি আরবও চাইছে তাদের অবস্থান যাতে কিছুতেই দুর্বল না হয়।

মূলত লেবাননের বিশ্বাসগত বিভাজনের ওপরই দেশটির রাজনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। খ্রিষ্টানদের সমর্থনদাতা হলো ফ্রান্স, শিয়াদের পেছনে রয়েছে ইরান এবং সুন্নিদের সমর্থনে রয়েছে সৌদি আরব। তবে সবকিছু ছাপিয়ে লেবাননে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর উত্থান এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৮২ সালে গঠিত হওয়া এই গোষ্ঠীটি বর্তমানে অনেকটা রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী। মূলত হিজবুল্লাহর কারণে লেবানন বিশ্ব রাজনীতিতে সর্বদা আলোচনায় থাকে।

হিজবুল্লাহ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি শিয়া মুসলিম সংগঠন, যেটি লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে। গত শতকের আশির দশকের গোড়ার দিকে ইসরায়েলের বিরোধিতা করার জন্য এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিয়া শক্তি ইরান এটি প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তখন দেশটির গৃহযুদ্ধের সময় ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবানন দখল করেছিল। পরবর্তী সময়ে হিজবুল্লাহ ১৯৯২ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং একটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সংগঠনটির উপস্থিতি দেখা যায়। হিজবুল্লাহর সামরিক শাখা লেবাননে ইসরায়েলি ও মার্কিন বাহিনীর ওপর মারাত্মকভাবে হামলা চালিয়েছিল। লেবানন থেকে ২০০০ সালে ইসরায়েল যখন সৈন্যদের প্রত্যাহার করে, হিজবুল্লাহ তখন সেই সৈন্য প্রত্যাহারের কৃতিত্ব নেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে আবারও ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ দ্বন্দ্ব চলছে। প্রায় এক বছর ধরে গুলিবিনিময়ের পর ইসরায়েল ও লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী এখন এক ভয়ানক সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে, যা পূর্ণ যুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। এটা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তবে ইসরায়েলের জন্য হামাসের চেয়ে হিজবুল্লাহ অনেক বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। অনেকে ইরান-সমর্থিত এই গ্রুপকে অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে আলোচনায় রাখে। লেবাননে হিজবুল্লাহর বহু ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ও সামাজিক শাখাও আছে।
হিজবুল্লাহ শুধু সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়, তারা একইসঙ্গে একটি রাজনৈতিক দল। লেবাননের সংসদে তাদের আইন-প্রণেতা আছে এবং কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন সরকারে তাদের প্রতিনিধি ছিল। অপরদিকে তাদের বিস্তীর্ণ সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডও রয়েছে। দক্ষিণ লেবানন ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে তারা স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পরিচালনা করে। সেসব এলাকায় তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে।

লন্ডনে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক লীনা খতিবের মতে, ইরানের সমর্থন হিজবুল্লাহকে লেবাননের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক গ্রুপ হিসেবে তাদের অবস্থান জোরদার করতে সহায়তা করেছে। একই সঙ্গে তারা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সমর্থিত সামরিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমরাস্ত্রে সবচেয়ে সুসজ্জিত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইসরায়েলের অন্য মিত্ররা বিশ্বাস করে, ভয়াবহ এ সংকটময় পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার একমাত্র উপায় গাজায় যুদ্ধবিরতি। যত দিন গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি না হবে, তত দিন ইসরায়েলে হামলা অব্যাহত রাখার কথা আগেই বলেছেন হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। যদিও গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি ইসরায়েল।

এদিকে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহ আক্রান্ত হলেও তাদের পালটা হামলা চালানোর যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে এবং এ কারণেই ইসরায়েলের মিত্র ও শত্রু উভয় পক্ষই আরও খারাপ কিছুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের বক্তব্যের আলোকে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলের পক্ষে আছে। বার্তা সংস্থা এপির খবরে এসেছে, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার মধ্যে গত বছর থেকে এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সুরক্ষা দেয়া এবং নিজেদের ওপর হামলা ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪০ হাজার সেনা, অন্তত এক ডজন যুদ্ধজাহাজ ও বিমানবাহিনীর চার স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর আগত যুদ্ধ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বরাবরের মতো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধেরও কোনো সমাধান হবে না এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। সবমিলিয়ে লেবানন ভূরাজনৈতিকভাবে এখন যুদ্ধবিপর্যস্ত এলাকায় রয়েছে। হিজবুল্লাহ দমনে ইসরায়েল হামলা চালাতে থাকলে বড় যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরায়েলের মিত্রদের উচিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে ইসরায়েলকে সংঘাত বন্ধে চাপ প্রয়োগ করা।