হিজাব বিতর্ক বনাম নারীর সম্মান ও মর্যাদা

মো. জিল্লুর রহমান: সম্প্রতি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে প্রতিবাদের মুখে রাজ্যের কর্তৃপক্ষ সব স্কুল-কলেজ কয়েক দিনের জন্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। খবরে প্রকাশ, কয়েক সপ্তাহ আগে রাজ্যের কয়েকটি কলেজ হিজাব পরা তাদের ইউনিফর্মের নীতিবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করলে চরম বিতর্কের সূত্রপাত হয়। পরে সেই ছাত্রীদের আবার ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়া হলেও তাদের কোনো ক্লাসে অংশ না নিয়ে আলাদা কক্ষে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আশেপাশের রাজ্যেও ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

এ ঘটনায় সম্প্রতি মুসকান খান নামের এক ভারতীয় ছাত্রীর একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাতে দেখা গেছে, সে হিজাব পরে তার স্কুলে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বেশ কিছু মানুষ তাকে অনুসরণ করছে এবং গেরুয়া রঙের স্কার্ফ পরিহিত একদল ব্যক্তি একটি ধর্মীয় সেøাগানে ছাত্রীটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর চিৎকার করছে। ওই ছাত্রীও তখন ভিড়ের দিকে ফিরে দু’হাত তুলে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে একাই প্রতিবাদ জানায়। ওই ঘটনার ভিডিওটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছে। কর্ণাটকের মাণ্ডা জেলার ওই ছাত্রী মুসকান খান সংবাদমাধ্যমকে বলছিল, ‘আমি আল্লাহু আকবর বলেছিলাম, কারণ আমি খুব ভয় পেয়েছলাম এবং যখন আমি ভয় পাই, তখন আল্লাহর নাম নিই।’

২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকের আরেকটি ঘটনা হয়তো অনেকের মনে আছে। সেখানে বলা হয়েছিল, ভারতের পুদুচেরি (পূর্বনাম পণ্ডিচেরি) বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিষয়ে মার্স্টার্সে সর্বোচ্চ নম্বরের অধিকারী রাবিহা আব্দুরেহিমকে হিজাবের কারণে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। সমাবর্তনে যোগ দিতে হলে হিজাব খুলে আসতে হবে এমন শর্ত দেয়ায় তিনি স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান করে শুধু সার্টিফিকেট নিয়েই বাসায় চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয়টির জওহরলাল নেহরু অডিটরিয়ামে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তার হাত থেকেই রাবিহা সাফল্যের পুরস্কার নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় তাকে অনুষ্ঠানে ঢুকতেই দেয়া হয়নি, কারণ সেই হিজাব! রাবিহার সঙ্গে এমন আচরণের খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। আসলে ভারতে এখন রাষ্ট্রীয় মদতে পদে পদে নিগৃহের স্বীকার হচ্ছেন মুসলিমরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও চলছে নানা বর্ণবৈষম্য।

সাম্প্রতিক কর্ণাটক রাজ্যের হিজাব নিয়ে এরই মধ্যে চরম বিতর্ক ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রীদের কেউ কেউ ধর্মীয় আচারের স্বাধীনতা চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। বিক্ষোভ শুরু হয়েছে মধ্যপ্রদেশ, পুদুচেরি, দিল্লি, কলকাতাসহ বেশ কিছু রাজ্য ও শহরে। শুধু দেশ নয়, অবাঞ্ছিত এই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। এককথায় কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করেছে। বিতর্ক শুরুর পরপরই নোবেলজয়ী ইউসুফজাই মালালা উদ্বেগ প্রকাশ করে টুইট করেছেন। এ-সংক্রান্ত এক টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘কলেজ আমাদের বাধ্য করছে হিজাব ও লেখাপড়ার মধ্যে একটি বেছে নিতে। হিজাব পরে স্কুলে যেতে না দেয়ার বিষয়টি ভয়ংকর। নারীদের কম অথবা বেশি পোশাক পরা নিয়ে আপত্তি জানানো অব্যাহত রয়েছে। ভারতীয় নেতারা, মুসলিম নারীদের এভাবে প্রান্তবাসী করে রাখা বন্ধ করুন।’

ভারতীয় সংবিধান অনুসারে হিজাব পরা একটি মৌলিক অধিকার, যা ভারতের সংবিধানের ১৪ ও ২৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এটি মুসলিম নারীদের ধর্ম পালনের জন্য অপরিহার্য। একে অন্যের বৈচিত্র্যকে সম্মান করার চেতনায় ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের বিকাশ ঘটেছে। এ কারণে ভারতের সংবিধানে বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর এই জিনিসটি এসেছে সামাজিক জীবন থেকে। যেমন দুর্গাপূজা, গণেশোৎসব, ছট, মহরম, কানওয়ার যাত্রা এ ধরনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে রাস্তায় যানজট হয়, কিছু শহর থমকে যায়, কিছু কাজও থেমে যায়; কিন্তু কেউ অভিযোগ করে না। সবাই জানে, এটি ভারতীয় সমাজের ছন্দ এবং ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ। যার যার ধর্ম তার তার কাছে প্রিয় ও পবিত্র। স্কুল-কলেজেও এই বৈচিত্র্য দেখা যায়। কেউ তিলক পরে, কেউ পাগড়ি বা টুপি পরে, কেউ হিজাব পরে এবং কেউ বোরকা পরে। এটিও ভারতীয় সমাজের সৌন্দর্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, চলমান বিতর্ক রাজনৈতিক মোড় নিয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদ মুসলিম ছাত্রদের সমর্থন করেছেন, অনেকে নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেন। আর এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াচ্ছে একটি উগ্রবাদী দল এবং তাদের উদ্দেশ্য এর মাধ্যমে ভোটের মাঠে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা।

উল্লেখ্য, ‘পর্দা’ শব্দটি মূলত ফার্সি, যার আরবি প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, আচ্ছাদন, বস্ত্রাদি দ্বারা সৌন্দর্য ঢেকে নেয়া, আবৃত করা প্রভৃতি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে উভয়ের মাঝে শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত যে আড়াল বা আবরণ রয়েছে, তাকে পর্দা বলা হয়। মূলত হিজাব বা পর্দা অর্থ শুধু পোশাকের আবরণই নয়, বরং সামগ্রিক একটি সমাজব্যবস্থা, যেটা নারী-পুরুষের মধ্যে ইসলামি ধ্যান-ধারণা ও ইসলামি মানসিকতা সৃষ্টি করে। বাহ্যিক পর্দার চেয়ে অন্তরের পর্দা অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। চোখের সামনে অশ্লীল ও অসুন্দর দৃষ্টিকটু কোনো কিছু দেখলে সেখান থেকে অন্যত্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই হচ্ছে মনের পর্দা।

অনেকেই মনে করে, পর্দার বিধান শুধু মুসলিম নারীর জন্য। এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। পুরুষের জন্যও পর্দা অপরিহার্য। তবে উভয়ের পর্দার ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যে শ্রেণির জন্য যে পর্দা উপযোগী, তাকে সেভাবে পর্দা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যে কোনো ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিই কুরআন-সুন্নাহর পর্দা-সম্পর্কিত আয়াত ও হাদিসগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে এই বাস্তবতা স্বীকার করবেন যে, ইসলামে পর্দার বিধানটি অন্যান্য হিকমতের পাশাপাশি নারীর সম্মান ও সমাজের পবিত্রতা রক্ষার জন্যই দেয়া হয়েছে। এজন্য এই বিধানের কারণে প্রত্যেককে ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। কৃতঘ্ন হয়ে এ বিধান সম্পর্কে অযথা আপত্তি করা উচিত নয়। হিজাব মুসলিম নারীদের একদিকে যেমন সম্মান ও আত্মমর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে, অন্যদিকে তেমনিভাবে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।

পর্দা ইসলামের সার্বক্ষণিক পালনীয় অপরিহার্য বিধান। কোরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলিল-প্রমাণাদির ভিত্তিতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতি বিধান যেমন ফরজ, তেমনি পর্দাও সুস্পষ্ট একটি ফরজ বিধান। আল্লাহ তায়ালাই নারী জাতিকে সুরক্ষিত ও নিরাপদে রাখার জন্য এই বিধান দিয়েছেন। এ বিধানকে হালকা মনে করা কিংবা এ বিধানকে অমান্য করার কোনো অবকাশ নেই। পর্দার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদের, তোমার কন্যাদের আর মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয় (যখন তারা বাড়ির বাইরে যায়), এতে তাদের চেনা সহজতর হবে এবং তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না।’ (সুরা আহজাব: ৫৯)।

আসলে ইসলামে পর্দা মানা ও শিক্ষা গ্রহণ করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ বা অত্যাবশীয় কাজ। ইসলামে নারীদের পোষাকি পর্দার চেয়ে পুরুষের চোখের পর্দা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হিজাব বা পর্দা নারীদের আত্মমর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। নারীদের সুরক্ষার জন্য পর্দার বিকল্প নেই। কিন্তু যথাযথ পর্দা প্রথা মেনে সহশিক্ষা গ্রহণে যেমন সমস্যা নেই, তেমনি কর্মক্ষেত্রে কাজ করতেও বাধা নেই। ইসলামি ও অ-ইসলামি বহু দেশে এর প্রচলন লক্ষ করা যায়। এমনকি পশ্চিমা সংস্কৃতির দেশগুলোতেও নারীরা হিজাব পরে লেখাপড়া করছে এবং চাকরিবাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ নিচ্ছে। ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পর্দাপ্রথা মেনে নারীরা যুদ্ধে পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছিল এবং সেই ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে মসজিদে জামাতে নামাজেও অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু অনেকে শরিয়াহ্ আইনের নামে বাড়াবাড়ি করেছে। ইসলামে বাড়াবাড়ি একটি চরম অপছন্দনীয় কাজ। ইসলাম কুসংস্কারে নয়, আধুনিকতায় বিশ্বাস করে।

নারীর সম্মান, মর্যাদা, তাদের সব অধিকারের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের কিছু বিধান রয়েছে। ইসলাম যতগুলো বিধান তাদের ওপর আরোপ করেছে, এর মধ্যে হিজাব বা পর্দা পালনের বিধান অন্যতম। এই বিধানটি মূলত ইসলামি শরিয়তের যথার্থতা, পূর্ণাঙ্গতা ও সর্বকালের জন্য অমোঘ বিধান হওয়ার এক প্রচ্ছন্ন দলিল। মূলত ‘হিজাব বা পর্দা’ নারীর সৌন্দর্য, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। এটি নারীদের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার অতি সহজ ও কার্যকর উপায়। ইসলাম পর্দা পালনের যে বিধান আরোপ করেছে, তা মূলত অশ্লীলতা ও ব্যভিচার নিরসনের লক্ষ্যে এবং সামাজিক অনিষ্টাশঙ্কা ও ফেতনা-ফ্যাসাদ থেকে বাঁচার নিমিত্তেই করেছে, নারীদের প্রতি কোনো ধরনের অবিচার কিংবা বৈষম্য সৃষ্টির জন্য করেনি। বরং তাদের পবিত্রতা রক্ষার্থেই তাদের ওপর এ বিধানের পূর্ণ অনুসরণ অপরিহার্য করা হয়েছে।

পর্দা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। কোরআন মজিদের কয়েকটি সুরায় পর্দা-সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অমুসলিমদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আমরা নিজেদের আর্দশ ত্যাগ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। আমাদের পরিবার ও সমাজেও পশ্চিমা সমাজের ভয়াবহ উপসর্গগুলো প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত। পশ্চিমা সভ্যতা যেসব মারণব্যাধিতে আক্রান্ত, তা থেকে যদি আমরা আমাদের পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করতে চাই, তার একমাত্র উপায় ইসলামের বিধান ও আদর্শের সামনে আত্মসমর্পণ। পরিবারিক শান্তি ফিরে পেতে চাইলে নারী-পুরুষ সবাইকে পর্দা-বিধানের অনুসারী হতে হবে।

আমাদের সমাজে নারীদের মধ্যে পশ্চিমা সংস্কৃতির চর্চা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তাদের তৈরি যেকোনো স্টাইলিশ পোশাক এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো নারীদের পর্দার সবচেয়ে বড় হাতিয়ারকেও তারা ফ্যাশন বানিয়ে ছেড়েছে। পর্দার নামে বাজারে তাদের তৈরি বাহারি ডিজাইনের বোরকা পাওয়া যায়, যাতে নারীদের শরীরের আকৃতি খুব সহজেই অন্যের দৃষ্টিগোচর হয়, ফলে পর্দার আসল উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়। ঢিলাঢালা বোরকাগুলোকে ঢাল বানিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় তারা সেগুলোকে সাধারণ মানুষের ঈমান হরণের প্রথম অস্ত্র বানিয়েছে। এভাবে সাধারণ মুসলিমরা খুব সহজেই তাদের ফাঁদে পা রাখছে। তাদের অনুসরণে পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্য হিজাবে আবৃত কিছু নারী কড়া বডি স্প্রে মেখে রাস্তায় বেরুচ্ছে। তাদের কাছ থেকেও সতর্ক ও সজাগ থাকা সচেতন মানুষের জন্য জরুরি। তবে ভারতে যে হিজাব বিতর্ক শুরু হয়েছে, বিশ্লেষকদের মতে, সেখানে সেটার মধ্যে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার উদ্দেশ্য রয়েছে।

অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চে ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর সেদেশের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন মুসলিম কমিউনিটির প্রতি যে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, তা বিশ্বব্যাপী বিপুল প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ঘটনার পরপরই নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্ট অধিবেশন আহ্বান করেন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংহতি জানানোর জন্য পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অধিবেশন শুরু করেন। তিনি কালো হিজাব পরিধান করে অধিবেশনে উপস্থিত হন, আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানান এবং অধিবেশনে তিনি ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বক্তব্য শুরু করেন। তার বক্তব্যে তিনি হামলাকারীর নাম ঘৃণাভরে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, তিনি তার নাম উচ্চারণ করতেও অস্বীকৃতি জানান, যা সারাবিশ্বে বেশ প্রশংসিত হয়। তিনি হামলাকারীকে আইনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাকে সন্ত্রাসী ও অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাছাড়া তিনি সন্ত্রাসী হামলার দিনটিকে মুসলিম কমিউনিটির জন্য ‘অন্ধকারতম দিন’ এবং যারা হামলার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন, তাদের তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। একইসঙ্গে তিনি মুসলিম কমিউনিটিকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য নিউজিল্যান্ডের সব রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশনকে কোরআন তেলাওয়াত ও আজান সম্প্রচারের নির্দেশ দেন। তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সম্প্রতি ক্রাইস্ট চার্চের সন্ত্রাসী হামলার বিচারের রায় প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশেও যখনই অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে এ ধরনের বৈষম্যমূলক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, তখনই সরকার বিষয়টি কঠোরভাবে মোকাবিলা করেছে, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা দেখিয়েছে; কিন্তু ভারতে সংখ্যালঘু কমিউনিটির সঙ্গে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ও অমানবিক নির্যাতনের সময় তাদের প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা শুধু বিরলই নয়, বরং অকল্পনীয়। কারণ তারা বৈষম্যমূলক আচরণের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে।

বিগত কয়েক শতকে ভারতীয় নারীর অবস্থা বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগে তাদের অবস্থার অবনতি, আর কয়েকজন সমাজ-সংস্কারকের প্রচেষ্টায় আবার সমমর্যাদার অধিকারে তাদের উত্তরণের ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। আধুনিক ভারতে নারীরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার অধ্যক্ষ, বিরোধী দলনেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপালসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন। ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত নারীর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত মূল বিষয়গুলো হলো সাম্য, মর্যাদা ও বৈষম্য থেকে স্বাধীনতা। এছাড়া নারীর অধিকার-সংক্রান্ত বহু বিধি প্রযোজ্য। ২০১৮ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি, লোকসভার (সংসদের নি¤œকক্ষ) অধ্যক্ষ ও লোকসভার বিরোধী দলনেতাÑতিনটি পদই অলংকৃত করেন মহিলারা। কিন্তু আজও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা লিঙ্গবৈষম্য ও অপরাধকর্মের শিকার। হিজাব পরার জন্য মুসলিম নারীরা যেভাবে বর্ণবৈষম্য ও নিগৃহের শিকার হচ্ছে, তা কোনোক্রমেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র যেখানে সব নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ, সেখানে কোনো উগ্রবাদী দল বা গোষ্ঠী যদি ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর নামে নিজ রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করে, সেখানে কখনও সুবিচার ও সুরক্ষা আশা করা যায় না।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০