হিমেল হত্যা: নিছক দুর্ঘটনা নয় বরং অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড

কাজী আশফিক রাসেল: তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে একটা গল্প পড়েছিলাম। অতি পুরোনো গল্প এটা। ঘোরতর এক নাস্তিক পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পাকিস্তান এলো। পাকিস্তান ছাড়ার পর সে দেশে ফিরে গিয়ে নিয়মিত চার্চে যাওয়া শুরু করল। তাকে অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলল,  পাকিস্তান ভ্রমণের পরে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করা শুরু করেছেন। তার কথা হলো, যদি ঈশ্বর নাই থাকে তাহলে ওই দেশটা (পূর্ব পাকিস্তান) চলছে কীভাবে? আমাদের পূর্বসূরিদের দীর্ঘসংগ্রাম ও অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাকিস্তানিদের কবল থেকে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটিকে উদ্ধার করেছি বটে, রাষ্ট্রের চরিত্রে তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারিনি। গত ১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাকচাপায় শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল নিহত হওয়ার পর থেকে এ গল্পটি আমার মনোজগতে বারবার উঁকি দিচ্ছে। যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সুরক্ষিত জায়গাতেও একজন শিক্ষার্থীর জীবনের নিশ্চয়তা থাকে না, সে দেশে বেঁচে থাকাটাই তো সপ্তাচার্যের বিষয়! রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনাটি অনেকের কাছে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো কোনো দুর্ঘটনা মনে হলেও আমার মতে এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়; বরং অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও দায়িত্বহীনতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা যায়, তেমনিভাবে পরিবহন খাতের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য বন্ধ করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, পরিবহনমালিকেরা সে দলের আশ্রয়পুষ্ট ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠেন। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইন যেমন প্রয়োগ হয় না, বিশেষজ্ঞদের সুপারিশও মানা হয় না। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ করা হলেও সড়কে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে। দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড নির্মাণ করার বিশেষজ্ঞদের কোনো সুপারিশই মানেনি সরকার। তাই বলব, হিমেল হত্যার দায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রকেও বহন করতে হবে। পিতাহারা ছেলেটি স্বামীহারা বিধবা মায়ের মুখে একঝলক হাসি ফোটাতে জীবনের ধাপে ধাপে ছিল সংগ্রামমুখর, অথচ তার বিধবা মা পেলো একমাত্র সন্তানের মস্তকহীন লাশ। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ডিগ্রি নিতে এসে সর্বস্ব হারানোর অসংখ্য উদাহরণ থাকতে পারে, তবে ক্যাম্পাসের ভেতর ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হওয়ার ঘটনা সম্ভবত এটিই প্রথম। আমার ভাবতেই গা শিউরে ওঠে; হিমেলের মা যদি জিজ্ঞেস করেন, আমার হিমেল বাবার ললাটে শেষবারের মতো একটা চুমু দিই অথবা তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে কবরে শুইয়ে দিই, কেউ কি মাথাটা এনে দিতে পারবেন? নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন এ জনপদে যেন এক বিলাসিতার নাম! মূলত দেশজুড়ে  মুনাফাখোরদের দুর্নীতি,  অনিয়ম, লুটতরাজ ও অব্যবস্থাপনার যে মহোৎসব চলছে- হিমেলের মস্তকহীন লাশ ছিল তারই এক খণ্ডচিত্র। আমরা যেন ভয়ংকর এক মৃত্যুর ফাঁদে পড়েছি। দেশের বাসাবাড়ি, সুউচ্চ বহুতল ভবন, সড়ক, মহাসড়ক, রাজপথ, নৌপথ, সেতু, সব যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর ফাঁদ। সড়কে বের হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিমেলের মতো গাড়ির চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাতে হবে আর অফিসে কিংবা বাসায় থাকলে আগুনে পুড়ে মরতে হবে। কখনো ঝালকাঠির সুগন্ধায় মাঝনদীতে লঞ্চে আগুন লেগে, কখনো পুরান ঢাকার নিমতলীতে, আবার কখনো আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে। একবার সাভারের রানা প্লাজা, আরেকবার চকবাজার। আবার চকবাজারের শোক কাটাতে না কাটাতেই বনানীর অগিকাণ্ডে অঙ্গার হওয়া লাশের মিছিল। এভাবে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড অথবা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন শবযাত্রায় যুক্ত হচ্ছে নতুন লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ আর স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদে চারদিক প্রতিনিয়ত ভারী হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর মিছিল শুধু দীর্ঘতরই হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে ২০ থেকে ২১ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে সড়কে পাঁচ হাজার ৪৭২ দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। কতসংখ্যক মানুষ আহত হয়েছেন সেই হিসাব নেই পরিসংখ্যানে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর হিসাব মতে, ২০২১ সালে তিন হাজার ৭৯৩ দুর্ঘটনায় চার হাজার ২৮৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৮০৫ জন। তবে সংগঠনটি বলছে, অন্তত ২০ শতাংশ দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসে না। আবার অনেকই দুর্ঘটনার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। ২০২০ সালের তুলনায় গত বছর সড়কে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ, সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। অথচ করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছর কয়েক ধাপে দেশজুড়ে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে মোট ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ ছিল। এত দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি আসলে কতটা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক, কিন্তু এ ধরনের অপমৃত্যু মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। প্রত্যেকটা হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর পুরোদেশ শোকের গভীরতায় আচ্ছন্ন হয়, কিন্তু এটা আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য যে এমন রোমহর্ষক ঘটনাগুলো আমাদের অনেকের কাছে নিতান্তই শোকের বিষয়,  শিক্ষণীয় নয়।  প্রত্যেকটি দুর্ঘটনা যেমন পুঁজিপতিদের অতি মুনাফাখোরী মনোভাবের প্রতিফলন তেমনি আমাদের অজ্ঞতা, জাতীয় অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতিহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অতীতের উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা লাভ করে আমরা একটু সচেতন হলেই অধিকাংশ সংঘটিত দুর্ঘটনা এড়াতে সক্ষম হতাম। তাই, অতীতের মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত এরকম ঘটনা অনবরত ঘটবে তা নিঃসংকোচে বলা যায়।

শিক্ষার্থী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০