তাপস কুমার, নাটোর: নাটোরের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প এখন হুমকির মুখে। পুঁজির অভাবে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এ শিল্প। অথচ এক সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এ জেলা থেকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন মানুষ মাটির দ্রব্য ছেড়ে সিলভার, মেলামাইন ও প্লাস্টিকসামগ্রী ব্যবহার করছেন। ফলে দিন দিন জৌলুস হারাচ্ছে এ শিল্প। এছাড়া জেলার সদর উপজেলাসহ অন্যান্য স্থানে পাল বংশের সদস্যরা পরিবর্তন করছেন পেশা। ফলে মৃৎশিল্পও সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
জানা গেছে, আগে মানুষ পারিবারিক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করত মাটির তৈরি হাঁড়ি, কলস, খেজুরের রস আহরণের হাঁড়ি, মাটির কুপি এমনকি বদনাও। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় দেখা যেত মাটির তৈরি বাঘ, হাতি, পাখিসহ আকর্ষণীয় খেলনা। এছাড়া মৃৎশিল্পের বিভিন্ন উপাদানে গ্রামীণ বাংলার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের রোমাঞ্চকর, মনোমুগ্ধকর ছবি ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। এর ওপর ভিত্তি করে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল অর্থনীতিও। বাজার চাঙা রাখতে এ শিল্পের কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু এখন ইচ্ছা থাকলেও পুঁজির অভাবে অনেক শিল্পী এ শিল্পকে ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এছাড়া বৈশাখী মেলাসহ বছরের অন্যান্য সময়ে অনুষ্ঠিত মেলা ও পূজা-পার্বনে মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরিতে পালপাড়ায় ধুম পড়ে গেলেও এখন আর সে দৃশ্য চোখে পড়ে না। নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলার তেবড়িয়া হাট পালপাড়া, আমহাটি, কাইশাবাড়ী, জগদ্বীশপুর, বাঙ্গালপাড়া গ্রামের বেশিরভাগ শিল্পী ব্যবসা ধরে রাখতে এ বছর শুধু হাঁড়ি পাতিল, ফুলের টব তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাদের অভিযোগ, এ শিল্পে সরকারের উদাসীনতা, সহজে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা না থাকায় তারা বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
নলডাঙ্গা উপজেলার বাঙ্গাল পাড়া, কাইসাবাড়ী, জগদ্বীশপুর পালপাড়া মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এ এলাকার অর্চনা দাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় বসে মা মেয়ে চানাচুর প্যাকেটিং করছেন। মৃৎশিল্পের দুরবস্থায় বিকল্প পেশা হিসেবে চানাচুর ভেজে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান তিনি। তিন মেয়ের পড়ালেখা ও ভরণ-পোষণের অর্থ জোগাড় করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছেন। তার মতো অবস্থা আরও অনেকেরই। কৃষিকাজ, গাড়িচালক, ব্যবসাসহ অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন।
মৃৎশিল্পী আনন্দ মোহন বলেন, ‘বর্তমানে মৃৎ শিল্পের বাজার খুবই খারাপ। কোনোরকম খেয়ে-পরে চলে।’ এ সময় শিল্পী না বাঁচলে শিল্প বাঁচে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার আলাদা ব্যাংক ঋণ, সরকারি-বেসরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করলে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
নাটোর সদরের তেবাড়িয়া পালপাড়া এলাকার কার্তিক পাল জানান, পূর্বে এখানকার সব পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেখানে সাত-আটটি পরিবার কোনো রকমে মৃৎশিল্পের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে।
বাগাতিপাড়া উপজেলার পাকা ইউনিয়নের পালপাড়ায় কথা হল বুদু পাল ও তার চাচাতো ভাই রবীন্দ্র পালের সঙ্গে। তারা জানান, এখানে তারা তিন ঘর বসবাস করছেন। তারা আট পুরুষ ধরে এ পেশা ধরে রেখেছেন। তবে তাদের সন্তানরা আর ওই পেশায় যাবে না বলে তারা জানান।
মৃৎশিল্পী নিমাই পাল বলেন, এখন আর মাটির তৈরি জিনিসের তেমন কদর নেই। মাটির দামও বেশি। সারা মাস কাজ করে জিনিস বিক্রির পর গড়ে এক হাজার টাকা লাভ হয়। এ অবস্থা দেখে নতুন প্রজš§ এ পেশায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে বড় ছেলে পড়ালেখা করে কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। ছোট ছেলেও অনার্স পড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া বিপ্লব ও বিষ্ণু জানান, তারা তাদের বাপ-দাদাদের পেশায় আসবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন। কেননা এ পেশায় নেই কোনো সামাজিক মূল্যায়ন, নেই অর্থ, নেই ভবিষ্যৎ। বরং আছে শুধু অবহেলা। তাই সবকিছু ভেবে তারা নতুন পেশায় যাওয়ার মনস্থির করেছেন।