Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 7:41 pm

হৃদরোগ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি সবচেয়ে জরুরি

ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত: কয়েকদিন আগেই বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে বিশ্ব হার্ট দিবস। এ দিবসের মূল লক্ষ্য হৃদয়কে ভালো রাখতে হƒদরোগ নিয়ন্ত্রণ করা। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার পাশাপাশি, ভৌগোলিক অবস্থান ও স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার দরুন বাংলাদেশের মানুষ জাতিগতভাবেই কর্মঠ। আমরা কর্মঠ থাকলেই সুস্থ থাকি, সুস্থ থাকে আমাদের হার্ট; আমাদের হƒদয়। কিন্তু বিগত অনেকগুলো বছর ধরে আমাদের পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থা, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতি কারণে আমরা হয়ে উঠেছি বিশ্বের অন্যতম হƒদরোগে আক্রান্ত হওয়া জাতির একটি। কারণ, বাংলাদেশের শতকরা ৬৭ শতাংশ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে; যার মধ্যে সবার উপরের দিকে আছে করোনারি হার্ট ডিজিজ, এনজাইনা, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ। অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর এই সংখ্যাটি প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার এবং এর মধ্যে ৩৪ শতাংশই হƒদরোগ। এর চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ হƒদরোগের ঝুঁঁকিতে রয়েছে। অর্থাৎ আমি আপনি এবং আমাদের পরিবার প্রত্যেকেই এই তালিকার অন্তর্গত। আর এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে শুধু চিকিৎসা নয়, প্রয়োজন সচেতনতা এবং সেই অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ। 

পরিসংখ্যানে হৃদরোগ

হৃদরোগ হলো হƒৎপিণ্ডের ধমনীর রোগ, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী এই রোগেরে পরিধিটা কতটুকু? ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীব্যাপী ১ কোটি ৮৬ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেন। এ সংখ্যাটি বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৩৩ শতাংশ। এটি যে কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ (দ্বিতীয় অবস্থানে ক্যানসার ১ কোটি, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ৩৭ লাখ এবং এইচআইভি এইডস ১০ লাখ)। এসব রোগের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছেÑউচ্চ রক্তচাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, ওবিসিটি বা স্থূলতা, বায়ুদূষণ, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত মদ্যপান, কিডনি রোগ এবং সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সকল ধরনের তামাক বা তামাকপণ্য সেবন। প্রতিবেদনে আরেকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী হƒদরোগের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে আছে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। অঙ্কের হিসাবে এটি ৭৫ শতাংশ প্রায়। অর্থাৎ পরিসংখ্যানেও বাংলাদেশ ঝুঁকির প্রথম দিকেই। আগেই বলেছি, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ হƒদরোগের ঝুঁকিতে আছেন। প্রতি বছর দেশে হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। হƒদরোগ একটি অসংক্রামক রোগ, যা বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর ৩৪ শতাংশের কারণ।

কেন বাড়ছে ƒদরোগের ঝুঁকি?

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, জিডিপির হার বৃদ্ধি প্রভৃতি দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। বেড়েছে ফাস্টফুডসহ চর্বিজাতীয় খাদ্যের জনপ্রিয়তা। এর সঙ্গে সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ডায়াবেটিস, কায়িক পরিশ্রমে অনিহা, স্থূলতা, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, অ্যালকোহল সেবন, তামাকপণ্যের বাড়াবাড়ি ব্যবহার, প্রত্যক্ষ ধূমপানের সঙ্গে সঙ্গে পরোক্ষ ধূমপান, মানসিক চাপ, হতাশা, রাস্তায় গাড়ির ধোঁয়াসহ সব ধরনের বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ প্রভৃতি বিষয় আমাদের মধ্যে হƒদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো তামাকপণ্য ব্যবহার করে। আর ধূমপানের কারণে হƒদরোগের ঝুঁকি বাড়ে কয়েকগুণ। তবে নারীদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে হƒদরোগের ঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, দেশে ৫০ বছরের পর প্রিম্যাচিউরড হƒদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়, তরুণদের মধ্যেও হƒদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। ৩০-৪০ বছর বয়সীরা তো বটেই, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও হƒদরোগ বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলেছে, যদিও এখনও এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়নি। এসবের অন্যতম কারণ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। বিশেষ করে ধূমপান, ফাস্টফুডসহ তেল-চর্বি জাতীয় এবং কার্বোহাইড্রেড সমৃদ্ধ খাদ্য বেশি গ্রহণ করা, শারীরিক পরিশ্রম না করা প্রভৃতি। অল্প বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হারও বাড়ছে, এটিও হƒদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনতে হবে একজন কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে অভিজ্ঞতা হলো দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। রয়েছে সীমাবদ্ধতাও। বাংলাদেশ হƒদরোগের চিকিৎসা খাতে যথেষ্ট উন্নতি করলেও প্রান্তিক পর্যায়ে প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অপ্রতুলতা হƒদরোগে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ না হওয়ার অন্যতম কারণ। আমাদের দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে হƒদরোগের ধারণা ও চিকিৎসা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধা রয়েছে, ধারণাও কম রয়েছে। যে কারণে এসব বিষয়ে তাদের সচেতনতাও কম।

বাংলাদেশে রাজধানীসহ বড় বড় শহরগুলোয় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে হƒদরোগের উন্নত চিকিৎসা রয়েছে। সরকার নানাভাবে উন্নত সেবা দেয়ার চেষ্টা করছে। জনসচেতনতা বাড়াতে নেয়া হচ্ছে নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি। কিন্তু এসব সেবা সম্পর্কে অবগত না থাকা এবং সঠিক প্রক্রিয়া না জানার কারণে ও শহরকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে প্রান্তিক পর্যায়ে হƒদরোগের সুচিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। বড় একটি জনগোষ্ঠী চিকিৎসার আওতার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ব্যয়বহুল হওয়াও রোগমুক্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আরেকটি কারণ। এভাবেই অসংখ্য রোগী চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যায়।

তবে চিকিৎসা ও হাসপাতালের সেবার চেয়ে হƒদরোগ থেকে মুক্তির জন্য সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই আমরা সুস্থ থাকতে পারি।

কী করা যেতে পারে

এক. হƒদরোগের চিকিৎসাকে উপজেলাসহ প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য বাজেটের  বরাদ্দ বৃদ্ধি জরুরি; দুই. কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হƒদরোগের সাধারণ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে; তিন. সরকারি হাসপাতালগুলোতে হƒদরোগের ব্যয়বহুল ওষুধ সরবরাহ করা এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা জরুরি;  চার. হাসপাতালগুলোয় হƒদরোগের সেবা দেয়ার জন্য চিকিৎসক ও নার্স  অপ্রতুল। এ বিষয়ে নজর দেয়া জররি; পাঁচ.  হƒদরোগ সম্পর্কিত গবেষণা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সেবার মান উন্নয়ন করা যেতে পারে; ছয়. হƒদরোগ মুক্তির মূল পথ চিকিৎসা নয়, সচেতনতা। শুধু দিবসগুলোয় নয়, হƒদরোগের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী নিয়মিত প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে সচেতনতা বাড়বে। কমবে রোগীর সংখ্যা; সাত. ধূমপানসহ সব ধরনের তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি সম্ভব হলে হƒদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত সংশোধন করতে হবে; আট. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, খাদ্য তালিকা থেকে চর্বি বাদ দেয়া, শারীরিক পরিশ্রম প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে; নয়. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং হতাশা থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রয়োজনে মনোবিদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং