হেঁটে যাই বিদ্যালয়, দেহ-মন সুস্থ রয়

নাঈমা আকতার: আমাদের সকালটা শুরু হয় নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর চিন্তা নিয়ে। কারও অফিসে, কারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোনো কাজে। সকালে রাস্তায় যে তীব্র যানজট থাকে তাতে চিন্তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হতে সময় লাগে না। সকালের স্কুল শুরুর সময়টায় যানজট ধারণ করে ভয়াবহ রূপ। এর পেছনে একটা বড় কারণ হলো একজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার। একটি ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় জায়গা দখল করে বেশি কিন্তু যাত্রী পরিবহন করে সর্বোচ্চ পাঁচজন (চালকসহ), কিন্তু দুটি ব্যক্তিগত গাড়ির জায়গায় একটি বাসের স্থান সংকুলান হয়, যা একেবারে যাত্রী পরিবহন করতে ৪০ জন। সম্পূর্ণ ট্রিপে একটি বাস প্রায় ২০০ যাত্রী পরিবহন করে। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যক্তিগত গাড়ির অধিক ব্যবহারে একদিকে যেমন যানজট বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে জ্বালানি ব্যবহারও বৃদ্ধি পায় বহুগুণে।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতার কারণ কি? একটি কারণ হলো, অপ্রয়োজনীয় লম্বা ট্রিপ। একটি সন্তান জন্মের পরই মা-বাবা চিন্তা করেন তাকে কোথায় পড়াবেন? সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তির আগ্রহ অনেক সময়ই এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়। পছন্দের নামি-ভালো স্কুলে পড়ানোর অভিপ্রায় থেকে দেখা যায়, ধানমন্ডি থেকে একজন শিক্ষার্থী যাচ্ছে গুলশানের স্কুলে। এই লম্বা ট্রিপ সংঘটিত হওয়ার ফলে যানজট তৈরি হচ্ছে, তার ভুক্তভোগী কিন্তু শিশুরাও। দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থেকে তারা হারিয়ে ফেলছে খেলাধুলার সময়, পারছে না নিজের শখের কাজটি করতে, পাচ্ছে না বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ; যা তাদের মনোজগতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আরেকটি কারণ হলো, গাড়িকে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক মনে করা। এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে অনেকে ১০ মিনিটের হাঁটা পথে ৩০-৪৫ মিনিট গাড়িতে বসে থাকে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৩৭টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ বা পার্ক নেই। ফলে নগরবাসী, বিশেষত শিশু-কিশোররা খেলাধুলা ও সামাজিকীকরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলেও শারীরিকভাবে তারা নিষ্ক্রিয় থাকছে এবং দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থাকায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে হেঁটে যাতায়াতের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে খুব সহজেই তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব।

হেঁটে যাতায়াতের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিশ্রম হবে, যা তার হƒদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং টাইপ-টু ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়ক। পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের ফলে মানসিক চাপ কমে যায় এবং ঘুম ভালো হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। শুধু তাই নয়, হাঁটার মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

আগেই উল্লেখ করেছি, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে যানজট হ্রাস ও সময়ের অপচয় হ্রাস সম্ভব। সেই সঙ্গে সম্ভব দুর্ঘটনা হ্রাস। এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ২৯৭। এর মধ্যে প্রায় ৩৮ শতাংশই পথচারী। ঢাকা শহরে প্রায় প্রতিটি পরিষেবা ২ কিলোমিটারের হাঁটা দূরত্বেই পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ যদি স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যাতায়াত করে, তাহলে গাড়ির ব্যবহার কমে যাবে এবং দুর্ঘটনার ভয়ও কমে যাবে।

বায়ুদূষণের কারণে দেশে প্রতি বছর মারা যায় ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ। গোটা বিশ্বে যানবাহন খাত থেকে ২৫ শতাংশ কার্বন নির্গমন হয়। হেঁটে এবং অযান্ত্রিক যানের মাধ্যমে অধিকাংশ যাতায়াত সংঘটিত হলে একদিকে যেমন বায়ুদূষণ হ্রাস পাবে, তেমনি বায়ুদূষণজনিত বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ, যেমনÑহƒদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার ইত্যাদি হ্রাস করা যাবে। শুধু বায়ুদূষণ নয়, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনার মাধ্যমে ঢাকা শহরের অপর একটি বড় চ্যালেঞ্জ শব্দদূষণও হ্রাস করা সম্ভব।

তবে এ কথাও সত্যি যে, ঢাকা শহরে প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ হেঁটে যাতায়াত করলেও এ শহরে পথচারীদের জন্য নিরাপদ ও স্বচ্ছন্দ পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। অনিরাপদ পরিবেশের কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াতে আগ্রহী হন না। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। প্রথমত, প্রতিটি এলাকায় সমমানের বিদ্যালয় নিশ্চিত করা হলে শিক্ষার্থীরা এলাকার বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহী হবে এবং গাড়িতে যাতায়াতের প্রয়োজন কমে যাবে। বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু এবং ছুটির সময়ে আশপাশের রাস্তায় যান্ত্রিক যানবাহনের চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সড়ক পথচারী ও অযান্ত্রিক যান চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হলে শিক্ষার্থীদের হেঁটে যাতায়াত অনেকটাই নিরাপদ হবে। রাস্তা পারাপার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে সমতলে রাস্তা পারাপারে পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং প্রদান, জেব্রা ক্রসিংয়ের সামনে যেন গাড়ি থামানো হয় তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। পাশাপাশি রাস্তায় গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলা, সামাজিক অপরাধ হ্রাস প্রভৃতি বিষয় নিশ্চিতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা; শিশুদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ট্রাফিক আইন ও রাস্তায় চলাচলে বিভিন্ন নিয়ম শেখানো প্রয়োজন।

সর্বোপরি, একটি পথচারীবান্ধব নগর গড়ে তোলায় আমাদের নগর কর্তৃপক্ষকে মনোযোগী হতে হবে। প্রয়োজন নির্বিঘ্নে ও নিরবচ্ছিন্ন পথচারী নেটওয়ার্ক; প্রশস্ত ফুটপাত ও তার নিয়মিত তদারকি; প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি, যেমনÑহুইল চেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য র‌্যাম্প, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য টেকসই টেকটাইলস; উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা; হকার ব্যবস্থাপনা; ফুটপাতে অবৈধ পার্কিং ও যানবাহন চলাচল বন্ধ করা; পথচারীদের সুবিধাদি, যেমনÑবসার ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, ছায়ার ব্যবস্থা, আলোর ব্যবস্থা, আবর্জনা পাত্র নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

শহরটি এমনভাবে গড়ে উঠতে হবে যেন একটি শিশু নির্বিঘ্নে-নিরাপদে হেঁটে যাতায়াত করতে পারে। যে শহরে একজন শিশু নিরাপদে হাঁটতে পারে, নিঃসন্দেহে সেই শহরে বৃদ্ধ, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সবাই নিরাপদে হেঁটে যাতায়াত করতে পারবে।

শহরে হেঁটে যাতায়াতের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ৩০ শতাংশ স্কুল ট্রিপ হয় হেঁটে (ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট স্টাডি ২০১০)। গবেষণায় দেখা গেছে, নিন্ম আয়ের এলাকায় প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। অর্থাৎ হেঁটে যাতায়াতের পরিবেশ উন্নত করা হলে একদিকে যেমন অনেক শিক্ষার্থীকে হেঁটে যাতায়াতে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হবে, তেমনি যারা ইতোমধ্যে হেঁটে যাতায়াত করছে, তারা উপকৃত হবে। এর মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতেও ভূমিকা রাখা সম্ভব। আমরা প্রত্যাশা করি, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় নগর কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দে হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াতের পথ নিশ্চিতে সচেষ্ট হবেন এবং একটি পথচারীবান্ধব নগর যাতায়াত ব্যবস্থা এ শহরে নিশ্চিত হবে।

উন্নয়নকর্মী

naima-2810@yahoo.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০