হেপাটাইটিস ভাইরাস থেকে বাঁচুন

Hepatitis infection.cartoon vector illustration.

মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যকৃৎ কিংবা লিভার। আমরা যা খাই, হজম হওয়ার পর তা রক্তে প্রবেশের জন্য লিভারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। খাবারের যে অংশ ভালো, তা রেখে মন্দটাকে অপসারণ করার কাজ লিভারের। প্রোটিনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ পরিবহন, রক্তের তারল্য বজার রাখা, রক্ত জমাট বাঁধা লিভারের কাজ। ভিটামিন এ, বি-১২ ও ই-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন সঞ্চয়ের কাজ করে লিভার। ফলে এটি আক্রান্ত হলে পুরো শরীরে এর প্রভাব পড়ে। কিছু ভাইরাস স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ তৈরি করে লিভারে। এই ভাইরাসগুলোকে হেপাটাইটিস ভাইরাস বলে। এর আক্রমণে সৃষ্ট রোগটিই ‘হেপাটাইটিস’।

এই ভাইরাস মূলত লিভারকে আক্রমণ করে। এটি একটি সংক্রামক রোগ। মানবদেহের সবচেয়ে ক্ষতিকারক ভাইরাস হেপাটাইটিস। দ্রুত সংক্রমণ ঘটছে এর। এই হেপাটাইটিস লিভারের অ্যাকিউট ও ক্রনিক সংক্রমণের জন্য দায়ী, যা যকৃতে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায়। বিশ্বের অন্যতম ঘাতক ব্যাধি লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার হতে পারে এর কারণে। রক্ত ও রক্তজাত পদার্থ মূলত এই ভাইরাসের বাহক। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না, কিন্তু এদের মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে। মানুষের লিভার সাধারণত পাঁচটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। ভাইরাসগুলো হচ্ছে হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি ও ই। এদের মধ্যে এ ও ই স্বল্পমেয়াদি প্রদাহ। বি, সি ও ডি দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ।

 

হেপাটাইটিস এ

খাদ্য ও পানীয় যদি কোনোভাবে মলমূত্রের সংস্পর্শে আসে, তবে হেপাটাইটিস এ ছড়ায়। সাধারণত শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। সাধারণত খাদ্য কিংবা পানির মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে।

 

হেপাটাইটিস বি

এটি সাধারণত রক্তের মাধ্যমে ছড়ায়। যেকোনো বয়সে হতে পারে। গর্ভকালে মায়ের শরীরে এ ভাইরাস থাকলে তা শিশুর শরীরেও প্রবেশ করে। ফলে জন্মের পর শিশু বিভিন্ন রোগে ভুগতে পারে। এই ভাইরাসের জিন লিভারের কোষের জিনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে লিভারের কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।

 

হেপাটাইটিস সি

হেপাটাইটিস সি ভাইরাস এক ধরনের ছোট, আবৃত, সিঙ্গল-স্ট্র্যান্ডেড, পজিটিভ-সেন্স আরএনএ ভাইরাস। এটি যকৃৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সি ভাইরাস এইচসিভি রোগ সৃষ্টি করে। এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সচরাচর কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ যকৃতে ক্ষত এবং কয়েক বছর পর সিরোসিস সৃষ্টি করে। সিরোসিস আক্রান্ত ব্যক্তির যকৃৎ অকার্যকর, যকৃতের ক্যানসার, খাদ্যনালি ও পাকস্থলীর শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যু হতে পারে।

 

হেপাটাইটিস ডি

ডি ভাইরাস বি ভাইরাসের সহযোগী। বি ভাইরাসের মতো সমান ক্ষতিকর। এই ভাইরাসটি পৃথকভাবে লিভার প্রদাহ করতে পারে না। ডি ভাইরাস বি ভাইরাসের আবরণে লিভারে প্রবেশ করে।

 

হেপাটাইটিস ই

এ ভাইরাসের মতো প্রায় একই কারণেই ছড়ায়। তবে এই ভাইরাসের ক্ষতি করার ক্ষমতা কম। গর্ভাবস্থায় ভাইরাসটি ক্ষতিকারক।

 

কীভাবে হতে পারে

রক্ত, লালা, বীর্য ও বুকের দুধ এক দেহ থেকে অন্য দেহে ভাইরাস বিস্তারে সহায়তা করে। আক্রান্ত মায়ের শিশু, আক্রান্ত পরিবারের অন্য সদস্য, রক্ত নেওয়া রোগী, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিরা যেমনÑচিকিৎসক, সেবিকা, ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ব্যক্তি, দন্তরোগের চিকিৎসকেরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। সমকামী, একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে যৌন মিলন প্রভৃতিও দায়ী। ইনজেকশনের মাধ্যমে এবং একই নিডল ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তি মাদকদ্রব্য নিলে। সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার করা টুথব্রাশ, রেজার কিংবা ব্লেড ব্যবহার করলে, সেলুনে ব্যব হার করা ক্ষুর বিভিন্ন জন ব্যবহারকালে হেপাটাইটিস বি সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া হেপাটাইটিস বিতে আক্রান্ত মায়ের গর্ভজাত সন্তানদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাস্তার খোলা খাবার বিশেষ করে শরবত, আখের রস, রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন তৈলাক্ত খাবার প্রভৃতি। যারা শহরে বাস করে কিন্তু পানি ফুটিয়ে পান করে না এবং গ্রামে ডোবা কিংবা নালার পানি পান করে তারা হেপাটাইটিস এ ও ই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় বেশি। তবে সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে করমর্দন করলে, হাঁচি দিলে, রোগীর পাশাপাশি বসলে এ ভাইরাস ছড়ায় না।

 

লক্ষণ

লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি হলে বেশকিছু শারীরিক লক্ষণ দেখা দেয়।

চোখ হলুদ হয়ে যায়

প্রস্রাবের রং হলুদ হয়

পেটে ব্যথা। সেইসঙ্গে জ্বর হয়

ক্ষুধামান্দ্য। বমি বমি ভাব কিংবা বমি হয়ে থাকে

মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা হয়

সব সময় অস্বস্তি অনুভব করে

গায়ের চামড়ার উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায়

সর্দি, দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা প্রভৃতি

 

প্রতিরোধ

সেলুনে চুল-দাড়ি কাটানোর সময় নতুন ব্লেড ব্যবহার করতে হবে

ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকা

নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখা

শিরাপথে মাদক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা

শরীরে ছিদ্র কিংবা উলকি আঁকার

ক্ষেত্রে সতর্কতা

 

আক্রান্ত হলে কী করবেন

নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক অন্যের ব্যবহƒত সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা। নিজের ব্যবহƒত জিনিস অন্যকে ব্যবহার করতে না দেওয়া

রক্ত কিংবা অন্য কোনো অঙ্গ দান করা থেকে আক্রান্ত ব্যক্তির বিরত থাকা

রেজার, ব্লেড ও দাঁত মাজার ব্রাশ অন্যের সঙ্গে আদান-প্রদান না করা

গর্ভবতী মহিলা যদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে দ্রুত ডাক্তারকে জানাতে হবে যেন গর্ভের শিশুর কোনো ক্ষতি না হয়

 

চিকিৎসা

হেপাটাইটিস ভাইরাস এ এবং ই আক্রান্ত ব্যক্তিরা যথাযথ বিশ্রাম নিলে দুই থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। হেপাটাইটিস এ এবং বি-এর টিকা নেওয়া। সিরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যকৃতের ক্যান্সারের জন্য রয়েছে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা। সি আক্রান্ত ব্যাক্তিদের ঝুঁকি বেশি। তাদের অ্যালকোহল ও যকৃতের জন্য বিষাক্ত পদার্থ পরিহার করা। সি-এর কোনো টিকা নেই। নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে এর জটিলতা থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া যায়। আক্রান্ত রোগীর খাবারদাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ ও ব্যবহার্য জিনিস আলাদা রাখা। যাদের লিভারে ভাইরাস বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে তাদের ক্ষেত্রে ইনজেকশন কিংবা মুখে নেওয়ার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়।

 

শিপন আহমেদ

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০