নিজস্ব প্রতিবেদক: একটি সুস্থ জাতি গঠনের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু দেশের জনগণের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিতে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। এ কারণে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, মজুত ও সংরক্ষণ, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে জনমনে সচেতনতা বৃদ্ধিতে দেশব্যাপী কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গঠন সময়ের দাবি।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের আয়েজনে ‘স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিতে স্থানীয় সংগঠনের ভূমিকা’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় গতকাল বক্তারা এ মতামত দেন।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারীর সভাপতিত্বে এবং প্রজেক্ট ম্যানেজার নাঈমা আকতারের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজির আলম, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ড. আবদুল আলীম এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা (প্রকাশনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ড. মোস্তাফা জামান, হেল্থ ব্রিজ ফাউন্ডেশন অব কানাডার আঞ্চলিক পরিচালক দেবরা ইফরইমসন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় নাঈমা আকতার বলেন, বর্তমানে দেশে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়সিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। খাদ্যপণ্যে কেমিক্যালের আশঙ্কায় জনগণ প্যাকেটজাত খাবারে ঝুঁকে পড়ছে; যা শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি প্লাস্টিক দূষণ বৃদ্ধি করে জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করছে। অনিরাপদ খাদ্যের সহজলভ্যতা, বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপন, বিশেষত নগর এলাকায় নিরাপদ খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা না থাকা এবং অতিরিক্ত মূল্য আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
দেবরা ইফরইমসন বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে দীর্ঘদিন সুস্থ থাকা এবং অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। আমাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, প্যাকেটজাত এবং বিদেশি ফলমূল বেশি ভালো। এ থেকে বের হয়ে এসে আমাদের দেশীয় ফলমূল-সবজি গ্রহণে গুরুত্ব দিতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবে কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ও ভোক্তারাও উপযুক্ত মূল্যে পণ্য পাচ্ছেন না। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন একটি ব্যাপক উদ্যোগ। এটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন গঠন এখন সময়ের দাবি।’
ড. আবদুল আলীম বলেন, ‘জনমনে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, শাকসবজি-ফল এবং মাছে ফরমালিন দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা জানাতে চাই, খাদ্যপণ্যে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় না। কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগের পর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ক্ষেত থেকে ফসল সংগ্রহ এবং বাজারজাত করে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। এ বিষয়গুলোতে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। জনগণের মাঝেও নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্থানীয় সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের আইন রয়েছে। এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
মো. বেনজির আলম বলেন, ‘আমাদের দেশ দানাদার খাদ্যে সাফল্য অর্জন করলেও নিরাপদ শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদনে আমরা পিছিয়ে আছি। ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে কৃষকদের সহায়তা করা এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক কৃষক জানেন না, কী কী কারণে খাদ্যগুণ নষ্ট হয়। সে ব্যাপারে তাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করা দরকার। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টায় এ কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে ভোক্তারাও সঠিক মূল্যে খাদ্যপণ্য কিনতে পারবেন।’
অধ্যাপক ড. মোস্তাফা জামান বলেন, ‘আমরা এখন বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের অনিরাপদ খাদ্যের বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপন করতে দেখি। এসব বিজ্ঞাপনের প্রচারণা বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। প্রতিদিন একজন মানুষের অন্তত ৪০০ গ্রাম শাকসবজি-ফল গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু সে পরিমাণ নিরাপদ খাদ্য মানুষ গ্রহণ করতে পারছে না। উৎপাদনের পাশাপাশি শক্তিশালী ও সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে একটি স্টোরেজ ব্যবস্থাও উন্নত করতে হবে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর যে সব পণ্য নেতিবাচক প্রভাব রাখে, সেগুলোয় সারচার্জ আরোপের মাধ্যমে হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমে অর্থায়ন করা যেতে পারে।’
গাউস পিয়ারী বলেন, ‘নগর এলাকায় নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিতে নগর কৃষি নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং প্রতিটি আবাসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভবনের ছাদে ছাদকৃষিকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। মিডিয়ায় স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রচারণা বাড়াতে উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন আয়োজনে অনিরাপদ খাদ্যের কোম্পানিগুলোকে স্পন্সর হিসেবে নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। জনগণের কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের বিকল্প নেই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সফলতা অর্জন সম্ভব।’