Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 1:51 am

হোম টেক্সটাইল ঘুরে দাঁড়াবে

আবুল কাসেম হায়দার: বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল নিয়ে কোভিড-১৯ পর নভেম্বর ২০২১ সালে আমি একটি নিবন্ধে বলেছিলামÑ দেশে ‘হোম টেক্সটাইল : নতুন সম্ভাবনা। সত্যেই হোম টেক্সটাইল একটি সম্ভাবনাময় খাত। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের পর জনশক্তি রপ্তানি বড় খাত। তৃতীয় খাত হিসেবে উঠে আসতে পারে হোম টেক্সটাইল। চতুর্থ রপ্তানি খাত হবে আইটি খাত। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এদেশের একমাত্র রপ্তানি পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য। আজ পাটের বাজার আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বেসরকারিভাবে কিছু পাটকল আজও কিছু কিছু পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে। এশিয়ার বিখ্যাত আদমজী জুট মিল আর নেই। পাটশিল্পকে আরও উন্নত এবং আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। কিন্তু দৃশ্যমান এখনও হয়নি। তবে কিছু কিছু বেসরকারি পাট শিল্প, উদ্যোক্তা রপ্তানিতে কিছুটা অবদান রাখার সামর্থ্য দেখাচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাকের পর চামড়া অথবা পাটপণ্যই ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি খাত। করোনার পরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে এই দুটি খাতকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হয় হোম টেক্সটাইল। অবশ্য এক বছরের ব্যবধানেই বড় ধরনের হোঁচট খায় খাতটি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে হোম টেক্সটাইল পণ্যের রপ্তানি কমে গত অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।

একাধিক ব্যবসায়ী জানান, তিন কারণে হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি কমেছে। প্রথমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে হোম টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা কমেছে। দ্বিতীয়ত, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির পর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তৃতীয়ত, দেশে সুতার দাম আবারও বেড়েছে। মূলত শেষের দুই কারণেই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে।

হোম টেক্সটাইল পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, দরজা-জানালার পর্দা, কুশন ও বিভিন্ন ধরনের টেরিটাওয়েল। বর্তমানে বিশ্বের ১২৫টি দেশে বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তবে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হচ্ছে বড় বাজার। হোম টেক্সটাইল খাতে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বর্তমানে রপ্তানি করছে ৫০-৬০টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নোমান গ্রুপ, হোম টেক্সটাইল লিমিটেড, সাদ মুসা, শাবাব ফেব্রিকস, অলটেক্স ইত্যাদি।

১৯৯০ সাল থেকে হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত শামসুদ্দিন টাওয়েল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাইনুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হল্যান্ডের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দেড় দশক ধরে প্রতি মাসে আমাদের কাছ থেকে ৯ থেকে সাড়ে ৯ টন বিভিন্ন ধরনের টাওয়েল নিত। সম্প্রতি সেই পণ্যের জন্য তারা পাকিস্তানে ক্রয়াদেশ দিয়েছে। কারণ, সেখানে তারা প্রতি কেজিতে ৩০ সেন্ট কম দাম পেয়েছে। এছাড়া জার্মানির একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে নিয়মিত একটি পণ্য নিচ্ছিল। তারা সেটি নেয়া বন্ধ করেছে। মূলত গ্যাস-বিদ্যুৎ ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি।’

উত্তর আমেরিকার হোটেলে ব্যবহƒত কম দামি টাওয়েলের ক্রয়াদেশ ভারত-পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে, এমন তথ্য দিয়ে মাইনুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রতি কেজি টাওয়েলের উৎপাদন ব্যয় আমাদের চেয়ে পাকিস্তানে ৩০ সেন্ট কম। বর্তমানে দেশি ও আমদানি করা সুতার দামের মধ্যে পার্থক্য ২৫-৩০ সেন্ট। ফলে বিদেশ থেকে সুতা আমদানির সুযোগ দিলেই আমরা হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে এগিয়ে যাব।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৫ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়। পরের বছর করোনা মহামারির কারণে তা কমে ৭৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তার পরের দুই বছর হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি বেশ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি ৪৯ শতাংশ বেড়ে ১১৩ কোটি ডলারে ওঠে। এর পরের অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ১৬২ কোটি ডলার হয়। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪৩ শতাংশ।

অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী হোম টেক্সটাইলের চাহিদা কমে। এতে দেশের হোম টেক্সটাইল খাতের রপ্তানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি ৩২ শতাংশ কমে ১০৯ কোটি ডলারে নেমেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১৮ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম।

বিশ্বে দুই বছর ধরে হোম টেক্সটাইল পণ্যের রপ্তানি কমছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ১২২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন বা ১২ হাজার ২৯০ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়, যা পরের বছর কমে ৯১ বিলিয়নে নামে। গত বছর রপ্তানি হয় আরও কম, যা পরিমাণে ৮৫ বিলিয়ন ডলার।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, চীন হোম টেক্সটাইলের শীর্ষ রপ্তানিকারক। গত বছর দেশটির হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি ১০ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৭৬৬ কোটি ডলারে নেমেছে। ভারতের রপ্তানি ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ কমে ৬০২ কোটি ডলার হয়েছে। পাকিস্তানের রপ্তানি অবশ্য ২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে ৫৬৪ কোটি ডলারে উঠেছে।

বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) চেয়ারম্যান এম শাহাদাৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর প্রতি কেজি টাওয়েলের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৪৫ সেন্ট। সম্প্রতি সুতার দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এ জন্য ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা আর প্রতিযোগিতায় পারছি না।’

এম শাহাদাৎ হোসেন আরও বলেন, হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে যে ভালো সম্ভাবনা আছে, সেটির প্রমাণ এক বছর আগেও মিলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানির সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কিছুটা বাড়বে। সেটি হলে ডলার-সংকটের এই কঠিন সময়ে রপ্তানি আয় বাড়বে।

কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে?

১. ২০২০-২১ সালে হোম টেক্সটাইল ১১৩.২০ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯.১৭ শতাংশ। ২০২১-২০ সালেও রপ্তানি হয়েছে ১৬২.১৯ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৪৩.২৮ শতাংশ। কিন্তু ২০২২-২৩ সালে এসে কেন রপ্তানি কমে হয়েছে মাত্র ১০৯.৪২ কোটি ডলার ও প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৩২.৪৭ শতাংশ। এর মূল কারণ আমাদের বের করতে হবে। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. বিগত বছরে সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মূল্যের বৃদ্ধি করেছেন প্রায় আগের তুলনায় দ্বিগুণ। তার জন্য দেশে সব উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ অতি বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিকারকরা প্রতিবেশী বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে পণ্য উৎপাদন খরচ নিয়ে বিপাকে পড়েন। রপ্তানি আদেশ কমে যায়। রপ্তানি কমে যায়। সেই জন্য প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, জ্বালানি মূল্যের অতি বৃদ্ধি রপ্তানি কমে যাওয়ার মূল কারণ। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি শিল্প খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ দিতে হবে। প্রতি বছর শিল্প খাতে মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না। কারণ কোনো উদ্যোক্তা যখন কোনো শিল্প স্থাপনে উদ্যোগ নেন তখন নিতে বর্তমান বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প তৈরি করেন। ব্যাংকগুলোও সেই অনুযায়ী ৫ বা ৭ বছরের জন্য শিল্পে ঋণ দেন। প্রতি বছর দ্বিগুণ বা তিন গুণ হারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করে সেই প্রকল্প স্থাপন করেন না।

৩. সরকার বিভিন্ন রপ্তানি খাতে রপ্তানির বিনিময়ে নগদ সহায়তা প্রদান করেন। এই ক্ষেত্রে হোম টেক্সটাইলের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে রপ্তানিতে সহায়তা করা দরকার। যাতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি আদেশ লাভ করতে এই খাতের বিনিয়োগকারীদের সহজ হয়। তাতে রপ্তানিও বৃদ্ধি পাবে। প্রবৃদ্ধিও আগের মতো বেড়ে যাবে।

৪. কোন কোন হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারক বলেছেন, তাদের বিনা শুল্কে সুতা আমদানির সুযোগ দিলে, তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। বিষয়টি তা নয়। হোম টেক্সটাইলের যাবতীয় সুতা দেশে উৎপাদিত হয়। আমদানির প্রয়োজন নেই। তবে সুতার মূল্য বেশি বলে অনেকে বলেন। তবে ভারতীয় সুতার চেয়ে বেশি। কারণ আমাদের তুলা শত ভাগ আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে সরকার গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করেছে। তাই সুতার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও গত দেড় বছর ধরে দেশের স্পিনিং মিলগুলো সুতা কম মূল্যে বিক্রি করে লোকসান দিয়ে মিলকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত সহযোগিতা প্রয়োজন। যেমন আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তার দেশের শিল্পের স্বার্থে প্রয়োজনে বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। কমিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের সরকার দেশের স্পিনিং খাতের স্বার্থে তৈরি পোশাক শিল্পের বিপরীতে সুতা আমদানি শতভাগ না দিয়ে শুধু ৫০ শতাংশ দিয়ে, বাকি ৫০ শতাংশ দেশের স্পিনিং মিল থেকে ক্রয় আদেশ দিলে দেশের স্পিনিং খাত রক্ষা পায়। ব্যাংকের দেনা ঠিকমতো শোধ করতে পারে। শ্রমিক কর্মচারীর বেতন ভাতা নিয়মিত দিতে পারে। তখন চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বেশি বিক্রি হলে সুতার দামও কমিয়ে আসবে। হোম টেক্সটাইল খাতের ব্যবসায়ীরা তখন কম মূল্যে সহজে দেশি সুতা পাবেন।

৫. শিল্প খাতের জন্য সরকারকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি কমপক্ষে ৫ বছর মেয়াদি করতে হবে। প্রতি বছর বা প্রতি ছয় মাস পর পর গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করলে এ খাত টিকে থাকতে পারবে না। তাতে রপ্তানি কমে যাবে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাবে। তখন রিজার্ভও কমে যাবে। তাই বিষয়টি শিল্পের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে স্পিনিং খাত তথা সব রপ্তানিকারক শিল্প খাতের জন্য বিশেষ বিবেচনা করতে হবে। ওয়ার্ক ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি প্রভৃতির পরামর্শ অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য নিয়মিত বৃদ্ধি করলে দেশের শিল্প বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগ হ্রাস পাবে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি,আইএফআইএল, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও  আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

E-mail-aqhaider@youthgroupbd.com