নিজস্ব প্রতিবেদক : গত এক যুগে বিশ্বের ১০৮টি দেশে সড়কে মৃত্যুর হার কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশে। ২০১০ সালে ওই দেশগুলোয় সড়কে যে পরিমাণ মানুষ মরেছে, ২০২১ সালে তা কমেছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি ঊর্ধ্বমুখী থেকেই গেছে।
গত বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়। বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে সংস্থাটি। তবে বৈশ্বিক এই সংস্থাটির তথ্য ও বাংলাদেশ সরকারের তথ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
২০২১ সালের তথ্য প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এতে দেখা যায়, ওই বছর বাংলাদেশে সড়কে প্রাণহানি হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। আর সরকারি হিসাবে ওই বছর সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮৪ জনের। সরকারি তথ্যের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি মৃত্যু দেখানো হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে।
সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযাযী, প্রায় এক যুগে মৃত্যুহার অর্ধেক কমিয়ে এনেছে ১০টি দেশ। দেশগুলো হলোÑবাংলাদেশে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা, বেলারুশ, ব্রুনেই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনিজুয়েলা।
বাংলাদেশে এমন একটি দিন পাওয়া যাবে না, সেখানে কোথাও না কোথাও ছোট-বড় কোনো সড়ক দুর্ঘটনার খবর লেখা নেই। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছেন দেশের আনাচে-কানাচে এসব দুর্ঘটনায়। সব দুর্ঘটনার খবর যে পত্রপত্রিকায় আসেও না।
সড়ক দুর্ঘটনার খবর অনেকটা গা সওয়া হয়ে যাওয়ায় বড় কোনো ঘটনা না ঘটলে এ খবরগুলো গুরুত্ব দিয়ে পত্রিকায় ছাপা হয় না। ফলে দুর্ঘটনার অনেক খবরই আড়ালে থেকে যায়। তৈরি হয় এক ধরনের তথ্য ঘাটতি।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সব খবরই পুলিশে রিপোর্ট করা হয় না। ঘটনাস্থলে কারও মৃত্যু হলে পুলিশ হয়তো নিজ উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর হাসপাতাল কিংবা বাড়িতে কেউ মারা গেলে সেই হিসাব পুলিশের কাছে প্রায়ই থাকে না বলা চলে।
সম্প্রতি নিজস্ব সূত্র ব্যবহার করে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ শুরু করছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি। তাতেও গুরুতর তথ্য ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করা হয়। বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহের মূল সূত্র গণমাধ্যম। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতো বেসরকারি যেসব সংস্থা যে তথ্য দিয়ে থাকে তার সঙ্গেও সরকারি হিসাবের বড় একটা ফারাক রয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য মানতে নারাজ।
তিনি বলেন, ‘আমরা রিয়াল ডেটা নিচ্ছি। একসময় পুলিশি ডেটার ওপরে আমাদের নির্ভরতা ছিল। এখন এক বছর ধরে আমরা নিজেরা ডেটা নিচ্ছি। প্রতিদিনের রিপোর্ট ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করছি। যদি কোনো গ্যাপ থাকে সেটার ব্যাপারে ও সবাইকে জানাতে বলছি। যদি কেউ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে আমরা সংশোধন করে নেব। মাস শেষে তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছি। শুধু প্রকাশ নয়, কেবিনেট থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত সব জায়গায় এর অনুলিপি দিচ্ছি।’
‘প্রতি মাসে আরও যারা কাজ করে, তাদের সঙ্গে হয়তো ৫০০-১০০০ পার্থক্য থাকছে। ওইটাও যদি কনসিডার করি, কোথায় ৩১ হাজার? তাদের (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার) বেইসটা কি। এ নিয়ে আমরা লেখালেখিও করেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে লিখেছি, মন্ত্রণালয় থেকেও লেখা হয়েছে। কীসের ভিত্তিতে তারা এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করে, আমরা বুঝি না। আমরা বলেছি আপনারা আসেন, আমাদের সঙ্গে বসেন। কিন্তু তারা কিছু বলেনি।’
তবে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি অনেক বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. সামছুল হক মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্যকে আমলে নিয়ে কাজ করা উচিত।
তার মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে রিপোর্টটি দিয়েছে এটা বাংলাদেশের জন্য আলাদাভাবে করা হয়নি। তারা একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পরিসংখ্যান দিয়েছে; যা সব দেশের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মৃত্যুরই কোনো হিসাব রাখা হয় না। বাংলাদেশে বিমা ব্যবস্থা শক্তিশালী না হওয়ায় কেউ নিহত বা আহত হলে উদ্ধারকারী যারা থাকেন আশপাশে তারা তাদের নিয়ে যান, যার ফলে এগুলো কখনও ডকুমেন্টেড হয় না।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেকে মোটরসাইকেল বা অনুমোদনহীন যানবাহন যেমন নছিমন, করিমন এগুলোকে দায়ী করে থাকেন।
অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন, ‘এসব যানবাহনের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সড়কে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যার ফলে ঝুঁকির মাত্রাটা বেড়েছে। এক সময় কিছুটা হলেও নছিমন, করিমন, ভটভটি সম্পর্কে সরকার, কোর্ট, পুলিশ একটু সচেতনভাবে ব্যবস্থা নিত। এটা এখন ফ্রি স্টাইলে চলছে, জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মবিলিটি বেড়েছে, গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, বাড়েনি সিস্টেম ড্রিভেন নিরাপদ সড়কের সুশৃঙ্খল অবস্থা।’
পুলিশের দেয়া তথ্যে সন্তুষ্ট থাকার বিপদ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তারা অসম্পূর্ণ তথ্যে সন্তুষ্ট থাকেন। কারণ এতে দেখানো যায় জাতিসংঘের দেয়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যাচ্ছে। যদি কম মৃত্যু দেখানো যায় তাতে সরকারের জন্যও ভালো।’
বাংলাদেশে কেন মৃত্যু এত বেশি সেটা নিয়ে আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইন না মানার সংস্কৃতিকে মূলত দায়ী করা হলেও, সড়ক উন্নয়নসহ আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা ও প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কিছুতেই সরকারের দুর্বলতা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।