রহমত রহমান: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও এলসি জটিলতা চলছে, যার প্রভাব পড়েছে কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ে। কোনো পণ্যের আমদানির পরিমাণ বেড়েছে, কমেছে রাজস্ব। আবার কিছু পণ্যের আমদানি কমেছে, বেড়েছে রাজস্ব। পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দশটি পণ্য আমদানিতে রাজস্ব আদায় কমেছে ১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুপারি ছাড়া ক্রুড সয়াবিল অয়েল, বেশি সিসির মোটরকার, জাহাজ, অ্যালয় স্টিল, স্টিল পাইপ, ড্রেজার, আঙ্গুর ও ফ্লোটিং স্ট্রাকচারের আমদানি কমেছে। এলএনজি আমদানি বাড়লেও রাজস্ব বকেয়া হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আবার দশটি পণ্যের আমদানি ও রাজস্ব আদায় ৫৩৫ কোটি টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑডিজেল, ফার্নেস অয়েল, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল শিট, পাথর, কয়লা, পাম অয়েল, আপেল ও কম সিসির মোটরকার। এলসি খোলার জটিলতা দূর হলে আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের
তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ১০টি পণ্যের আমদানি কমেছে প্রায় ৭৭ শতাংশ। এ দশটি পণ্য সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়। আর রাজস্ব কমেছে প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় এলএনজি বা প্রাকৃতিক গ্যাস। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সবচেয়ে বেশি এলএনজি আমদানি করে থাকে। রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করেছে, তার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ বকেয়ার জন্য চলতি অর্থবছর কাস্টমস রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত অর্থবছর ৫ মাসে এলএনজি আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৮৩৭ মেট্রিক টন, যাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯০২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে মাত্র ৩৭৫ মেট্রিক টন, রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ১৭ হাজার ১০৭ মেট্রিক টন সুপারি আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২২৮ কোটি টাকা। পাঁচ মাসে সুপারি আমদানি কমেছে ৯৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছর ক্রুড সয়াবিন অয়েল আমদানি বাড়লেও রাজস্ব কমেছে। পাঁচ মাসে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬ মেট্রিক টন ক্রুড সয়াবিন অয়েল আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৬৪ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর দুই লাখ ৬৯ হাজার ৪৭৯ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৪৫৪ কোটি টাকা। আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ। ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসির মোটরকার আমদানি হয়েছে ২২ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ৩১১ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১১৯ কোটি টাকা। মোটরকারের আমদানি কমেছে ৯৩ শতাংশ। জাহাজ (ব্রেকিং) ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪১ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় ৯ লাখ ৭২ হাজার ২১৬ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪৬ কোটি টাকা। আমদানি কমেছে ৬৭ শতাংশ। স্টিল পাইপ ১৭৩ মেট্রিক টন আমদানিতে কোনো রাজস্ব আদায় হয়নি। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ১৭ হাজার ৩০৩ মেট্রিক টন আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৫৫ কোটি টাকা। ৬ হাজার ৯৩ মেট্রিক টন ড্রেজার আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র দুই কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ৯ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন ড্রেজার আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৫৭ কোটি টাকা। আমদানি কমেছে ৩৭ শতাংশ। ২৩ হাজার ৭১ মেট্রিক টন আঙ্গুর আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২১১ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ৪৫ হাজার ৬৭৩ মেট্রিক টন আমদানির বিপরীতে আদায় হয়েছিল ২৬৪ কোটি টাকা। আঙ্গুর আমদানি কমেছে ৪৯ শতাংশ। ফ্লোটিং স্ট্রাকচার ৬৩২ মেট্রিক টন আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় এক হাজার ৩৫৪ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৫১ কোটি টাকা। আমদানি কমেছে ৫৩ শতাংশ।
অন্যদিকে পাঁচ মাসে ১০টি পণ্যের মধ্যে কখনও আমদানিতে কমেছে, বেড়েছে রাজস্ব আদায়। আবার কখনও পণ্য আমদানি বেড়েছে, কিন্তু কমেছে রাজস্ব আদায়। ১০টি পণ্যের আমদানি বেড়েছে ৮ শতাংশ, কিন্তু রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৫৩৫ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান অনুবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, পাঁচ মাসে হাই স্পিড ডিজেল আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৯৩ মেট্রিক টন। যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে দুই হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ১৪ লাখ ৬২ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক হাজার ৬১২ কোটি টাকা। ফলে ডিজেল আমদানি বেড়েছে ৪৯ শতাংশ (প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টন), আর রাজস্ব বেড়েছে ৪৫ শতাংশ (৭২৪ কোটি টাকা)। ফার্নেস অয়েল আমদানি কমলেও রাজস্ব আদায় বেড়েছে। পাঁচ মাসে ফার্নেস অয়েল ১৮ লাখ ৭ হাজার ৬৬৯ মেট্রিক টন আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে দুই হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময় ২০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬৮ মেট্রিক টন আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর ফার্নেস ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯৯ মেট্রিক টন কমলেও রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২৮৯ কোটি টাকা।
হিসাবে আরও দেখা গেছে, পাঁচ মাসে চিনি আমদানি ও রাজস্ব দুটোই কমেছে। ৭ লাখ ৭১ হাজার ২২ মেট্রিক টন চিনি আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময়ে ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৮২২ মেট্রিক টন আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল দুই হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। চিনি আমদানির পরিমাণ ২৬ শতাংশ ও রাজস্ব ২১ শতাংশ কমেছে। ৮৬ লাখ ৩৮ হাজার ৯২ মেট্রিক টন সিমেন্ট ক্লিংকার আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫৫৮ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে এক হাজার ১৭২ কোটি টাকা। সিমেন্ট ক্লিংকারে রাজস্ব বেড়েছে ১০৪ কোটি, আমদানি কমেছে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন। পাঁচ মাসে প্রি-ফেব্রিকেটেড স্টিল আমদানি বেড়েছে ৫৬ হাজার ৯০৫ মেট্রিক টন আর রাজস্ব বেড়েছে ৫৯ কোটি টাকা। পাথর আমদানি বেড়েছে ৫ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৯ মেট্রিক টন, রাজস্ব বেড়েছে ১৪৮ কোটি টাকা।
পাঁচ মাসে ২৬ লাখ ৫৬ হাজার ৮১৬ মেট্রিক টন কয়লা আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছর একই সময়ের চেয়ে কয়লার আমদানি বেড়েছে ৮ লাখ ২ হাজার ৬৯৪ মেট্রিক টন, রাজস্ব বেড়েছে ১৮০ কোটি টাকা। পাম অয়েল আমদানির পরিমাণ বাড়লেও রাজস্ব কমে গেছে। পাঁচ মাসে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন পাম অয়েল আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪৩৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের চেয়ে আমদানি বেড়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৯৪ মেট্রিক টন, রাজস্ব কমেছে ৪৭৫ কোটি টাকা। আপেল আমদানির পরিমাণ কমলেও রাজস্ব বেড়েছে। পাঁচ মাসে ৮৩ হাজার ৬৯৩ মেট্রিক টন আপেল আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪১৩ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছর একই সময় এক লাখ ১৮ হাজার ১০৮ মেট্রিক টনের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৯১ কোটি টাকা। এছাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ সিসির মোটরকার আমদানি ৩ শতাংশ ও রাজস্ব ১২ শতাংশ কমেছে। কয়েকজন কাস্টম কমিশনার ও ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব আর দেশে এলসি নিয়ন্ত্রণের কারণে বেশি রাজস্ব পাওয়া কিছু পণ্যের আমদানির পরিমাণ কমেছে। এতে রাজস্ব কমেছে। আবার কিছু পণ্যের আমদানি বেড়েছে। তবে শুল্ককর কমানোর ফলে রাজস্ব কমেছে। আর কিছু পণ্যের আমদানি কমেছে, কিন্তু ওই পণ্যে শুল্ককর বাড়ানোর ফলে রাজস্ব বেড়েছে।