বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

১০ বছরে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে আড়াই গুণ

শেখ আবু তালেব: বছর ঘুরলেই বাড়ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঋণের পরিমাণ। গত ১০ বছরে এর পরিমাণ বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে সরকারের। গত ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয় হাজার ৭৭৫ কোটি ডলার।

বৈদেশিক ঋণ-সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট স্ট্যাটিসটিক্স, ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে দেশে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল দুই হাজার ৬৫৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৬ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৪৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০১৭ সালে চার হাজার ৬৮১ কোটি ৯০ লাখ, ২০১৮ সালে পাঁচ হাজার ২১৩ কোটি ৮০ লাখ, ২০১৯ সালে পাঁচ হাজার ৭০৯ কোটি ৪০ লাখ এবং সর্বশেষ ২০২০ সাল শেষে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৭৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি ঋণ যে হারে বাড়ছে, তাতে এর পরিমাণ একসময় বড় দায় হয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের সামনে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধি আরও না হলে চাপে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তখন ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা কমিয়ে পুঁজিবাজার থেকে আইপিও বা বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাত হচ্ছে ২২ শতাংশ। আর মোট বৈদেশিক ঋণের ৭৬ শতাংশই সরকারি পর্যায়ে। অবশিষ্ট অংশটুকু বেসরকারি খাতে। বেসরকারি খাতের প্রায় সবটুকুই স্বল্পমেয়াদি।

বিদেশি ঋণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপির আকার বেড়েছে সরকারি হিসাবে। কিন্তু জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ সেভাবে বাড়েনি। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাতে বর্তমানে বিশ্বের সর্বনি¤œ দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। রাজস্ব আয় না বাড়ায় সরকার বিদেশি ঋণে ঝুঁকছে। সুদের হার কম হলেও একসময় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বৈদেশিক দায় পরিশোধের সময় রিজার্ভে চাপ পড়বে। রেমিট্যান্সের পরিমাণ যদি না বাড়ে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বৃদ্ধি পাবে। টাকার মান আরও কমে যাবে, সম্প্রতি যা দেখা গেছে।

ঋণ নেয়ার প্রবণতা ও এর ঝুঁকির বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অবকাঠামো নির্মাণে বড় ধরনের ঋণ নিতে হচ্ছে। মেগা প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পেই সবচেয়ে বেশি গেছে। ঋণ পরিসেবাও বাড়ছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের অনুপাত তিন শতাংশের মতো। এখন আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হয়েছি। এতে আমাদের সহায়তা ও সুদহার সুবিধা কমিয়ে দেয়া হবে। আগামীতে সুদহার বাড়বে। ঋণের মেয়াদ কমে যাবে। এতে দায় পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এখন দ্রুত প্রকল্প কাজ করতে শেষ হবে। সময়মতো করতে হবে, সুশাসনের দিকে, সাশ্রয়ীভাবে করার গুরুত্ব বেড়ে যাবে। এদিকে গুরুত্ব দিতে পারলে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে সমস্যা হবে না।’

তিনি আরও বলেন, বিশেষ নজর দিতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার দিকে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকল্পের সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ করতে হবে। নইলে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে লাভবান হওয়া যাবে না। ঋণের উৎসের বৈচিত্র্যকরণে যেতে হবে বাংলাদেশকে। দেশের অভ্যন্তর থেকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে। এতে দেশের জনগণকেও মেগা প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা যাবে। এছাড়া মেগাপ্রকল্পগুলো সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) যৌথ উদ্যোগেও হতে পারে। তাহলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়বে। দেশেই এ বিষয়ে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি গড়ে উঠবে। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিলে একটি ভারসাম্য থাকবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশেষ করে গত বছরে বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল আট দশমিক ৯ থেকে ৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ। ২০২০ সালে তা হয়েছে ১৮ দশমিক সাত শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি উৎসের দিকে কিছুটা যেতে হবে। এক্ষেত্রে দেখতে হবে ঋণগুলো স্বল্প সুদে ও কঠিন শর্ত ছাড়াই হচ্ছে কি না। স্বল্প সুদ ও সহজ শর্তের ঋণ আমাদের জন্য ভালো। কিন্তু বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে রয়েছে। এখন কিন্তু সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদ সুবিধা কমে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পেতেও বাংলাদেশকে সমস্যায় পড়তে হবে। তাই বিদেশি ঋণের অর্থ অহেতুক ব্যয় করলে কিংবা অন্যান্য খাতকে সুবিধা না দিলে ঝুঁকি তৈরি করবে। ঋণ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে না পারলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে বাজেট বাস্তবায়ন, রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়াবে।

প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী জানান, বর্তমানে দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ ডলার।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০