মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ: ২০০৮ সালে দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫১টি। বর্তমানে এ সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। আর এক দশক আগে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ৬৪১ জন। ১০ বছরের মাথায় ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে তিন লাখ ৫৪ হাজার ৩৩৩ জন। অর্থাৎ ১০ বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
অন্যদিকে দেশে বেড়েই চলছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। হু হু করে শিক্ষিত শ্রেণির সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেকাররা কিছু একটা করতে পারলেও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় উচ্চশিক্ষিতরা সব ধরনের কাজে যুক্ত হতে পারেন না। শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোট বেকারের ৪০ শতাংশই শিক্ষিত। আবার এদের মধ্যে একটা বড় অংশ উচ্চশিক্ষিত। ওই জরিপ অনুযায়ী প্রতি পাঁচজন বেকারের মধ্যে দুজন উচ্চ মাধ্যমিক অথবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। তাই উচ্চশিক্ষা বাড়ার হারকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন উচ্চশিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থান না হলে এই উচ্চশিক্ষা টেকসই প্রবৃদ্ধিমূলক হবে না। তাই গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষা প্রসারের পরামর্শ তাদের।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, তরুণ শ্রেণি উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হচ্ছে, এটা ইতিবাচক। এতে আমাদের শিক্ষার হার বাড়ছে। আমরা শিক্ষায় এগোচ্ছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই শিক্ষাকে টেকসই করতে হবে, প্রবৃদ্ধিকে কর্মসংস্থানমুখী করতে হবে। এজন্য কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দেন এই গবেষক।
তিনি বলেন, আগামীতে যে অর্থনীতি আসবে তা হবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর। তাই আমাদের শিক্ষিত তরুণদের আরও বেশি প্রযুক্তি জ্ঞান বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাইলে আমাদের কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। কিন্তু নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিশেষ করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসছে। সেটা মোকাবিলায় দক্ষ জনবলের প্রয়োজন। আমাদের কারিগরি শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। সেইসঙ্গে শিক্ষিত তরুণরা যাতে সহজে উদ্যোক্তা হতে পারে, সেই বিষয়টিতেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৯ সালে দেশের মোট ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ছিল দুই লাখ ৯৩৯ জন। পরের বছর ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় না বাড়লেও প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হয় দুই লাখ ২০ হাজার ৭৫২ জন। ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ে একটি আর ৬০ হাজার বেড়ে শিক্ষার্থী হয় দুই লাখ ৮০ হাজার ৮২২ জন। ১২ শতাংশ বেড়ে ২০১২ সালে শিক্ষার্থী হয় তিন লাখ ১৪ হাজার ৬৪০ জন, পরের বছর ২০১৩ সালে হয় তিন লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ জন, ২০১৪ সালে তিন লাখ ৩০ হাজার ৭৩০ জন, ২০১৫ সালে তিন লাখ ৫০ হাজার ১৩০ জন ও ২০১৬ সালে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা হয় তিন লাখ ৩৭ হাজার ১৫৭ জন।
দেখা যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪২ দশমিক ৪৬ ভাগ বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষিবিজ্ঞান অনুষদে অধ্যয়নরত ছিল। ব্যবসায় প্রশাসনে ছিল ৩২ দশমিক ৫০ ভাগ আর কলা আর সামাজিক বিজ্ঞান, শিক্ষা ও আইন বিষয়ে অধ্যয়নরত ছিল ২১ দশমিক ৩৫ ভাগ শিক্ষার্থী।
এদিকে হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও ব্যবস্থাপনা নিয়েই রয়েছে নানা প্রশ্ন। বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিচালনা নিয়ে খোদ ইউজিসিই প্রশ্ন তুলেছে।
সবশেষ প্রতিবেদনে ইউজিসি বলেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী একটি সেমিস্টারে শুধু দুটি কোর্স নিয়ে পূর্ণকালীন শিক্ষার্থীর মর্যাদা পাচ্ছে। স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শুধু দুটি কোর্স গ্রহণের সুবিধা থাকায় তারা প্রচুর অবসর সময় পাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছাড়া অন্যদিকে সময় দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেজন্য ইউজিসি মনে করে, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে প্রতি সেমিস্টারে কমপক্ষে তিনটি কোর্স আবশ্যিক করা এবং শরীরচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রায়ই দেখা যায় বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান করে না। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিরীক্ষিত বার্ষিক হিসাব ইউজিসির কাছে নিয়মিতভাবে দাখিল করে না, যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের লঙ্ঘন। এসব বিষয়ে তাই সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন বলে মনে করে ইউজিসি।
জানতে চাইলে ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ১০ থেকে ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম শ্রেণিতে আছে। এদের শিক্ষার মান সন্তোষজনক এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে ভালো করছে। ২০ থেকে ২৫টির শিক্ষার মান তেমন ভালো না হলেও তারা চেষ্টা চালাচ্ছে। বাকিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার জন্য যে মান থাকার কথা, তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সংকট ও অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক প্রবণতা বারবার উঠে এসেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত আসন না থাকায় অনেকে বাধ্য হয়েই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির আরও কাজ করতে হবে।
এদিকে শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রাথমিক স্তর পাস করা বেকার আছে চার লাখ ২৮ হাজার। প্রাথমিক স্তর পাস করাদের মধ্যে বেকারত্বের হার দুই দশমিক সাত শতাংশ। মাধ্যমিক পাস বেকারের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। তবে মাধ্যমিক পাস করাদের মধ্যে বেকারত্বের হার চার দশমিক সাত শতাংশ। যদিও উচ্চমাধ্যমিক পাস তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৫ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ছয় লাখ ৩৮ হাজার তরুণ-তরুণী কোনো কাজ পাননি। তারা আর পড়াশোনা করতে চান না, কাজ করতে চান। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চার লাখ পাঁচ হাজার লোক এখনও পছন্দ অনুযায়ী কাজ পাননি। স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ১১ দশমিক দুই শতাংশ। অন্যদিকে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি, এমন মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম, মাত্র তিন লাখ।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যত বেশি শিক্ষিত হয়, বেকার হওয়ার ঝুঁকি তত বেশি হয়। দেশের মোট যুবকদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার। বেকারত্ব কমিয়ে আনতে সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।

Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 3:32 pm