১২ কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ ৮,৭৩০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। শুরুর কয়েক বছর ছোট আকারের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া হলেও পরবর্তীকালে বেসরকারি খাতে আসে বড় আকারের বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তাই প্রতি বছর গুনতে হয় মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ।

সময়ের সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে এসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা। ফলে বেড়ে চলেছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধও। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। এ সময়ে শীর্ষ ১২টি কোম্পানি ৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা গত অর্থবছরের প্রদত্ত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৬৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।

বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনাবিষয়ক কর্মজোটের (বিডব্লিউজিইডি) প্রকাশিত ‘দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠেছে। গতকাল প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

এতে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ৩৭টি কোম্পানিকে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি পরিশোধ করেছে। আগের অর্থবছরের চেয়ে তা ২১ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫৪.৫ শতাংশ বেশি।

এদিকে গত অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়কারী শীর্ষ ১২টি কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আর ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ, বাংলা ট্র্যাক, চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) ও ওরিয়ন গ্রুপ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিদ্যুতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক। দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অব্যবহƒত অবস্থায় পড়ে আছে এবং বসে বসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা আদায় করা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু সরকার কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে, যার ফলে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা বহন করতে হচ্ছে।

অতি-সক্ষমতা ও উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জের ওপর বিডাব্লিউজিডির রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি বাংলাদেশ নতুন জীবাশ্ম জ্বালাানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কোটি কোটি টাকা খরচ করা অব্যাহত রাখে; তবে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বাড়তেই থাকবে এবং তা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।

এদিকে নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে প্লান্ট লোড ফ্যাক্টর কমপক্ষে ৭০ শতাংশ নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষরের সময় ৮০ শতাংশ লোড ফ্যাক্টর নির্ধারণ করা হয়। যদিও বর্তমানে ৪১ দশমিক ৮৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষমতা অব্যবহƒত পড়ে আছে এবং তা ব্যয়ের বোঝা বাড়ানো ছাড়া বাংলাদেশের ভোক্তাদের আর কোনো কাজে আসছে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পরপর দুই বছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান পিডিবির জন্য একটি অশনিসংকেত, যে কারণে পিডিবি এমন একটা সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে যখন কভিড-১৯ মহামারির কারণে স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা দরকার ছিল।

বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব ও প্রতিবেদনটির অন্যতম লেখক হাসান মেহেদী বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদিত সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছে গেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে আট দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এখনও বছরে আট হাজার মেগাওয়াটের বেশি ক্যাপাসিটি অব্যবহƒত অবস্থায় আছে। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মাত্র ১৫৩ দিন চলমান ছিল এবং ২১২ দিন অলস বসেছিল।

তিনি আরও বলেন, গত অর্থবছর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে আট দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। প্রবণতাটা হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় বেশি ব্যয় করছে, যাতে ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এত বিশাল ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার জন্য মোট ৪৯ হাজার ৩৯২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এর অধিকাংশই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। যদিও পেট্রোবাংলা বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের মাত্র ৫৫ দশমিক ৩০ শতাংশ সরবরাহ করতে সক্ষম।

প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ও শেয়ার বিজের প্রধান প্রতিবেদক ইসমাইল আলী বলেন, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও সেগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদর্শ কোনো মানদণ্ডও নেই। ২০১২ সালে একটি (বিবিয়ানা-২) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উš§ুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। একটিমাত্র কোম্পানি (সামিট গ্রুপ) দরপত্রে অংশ নেয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি ধরা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন সেটিকেই আদর্শ ধরে নিয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। যদিও গত এক দশকে বৈশ্বিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ব্যয় প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থাপিত সক্ষমতা বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। তাই ২০২৫-২০৩০ সালের মধ্যে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস পড়ে থাকবে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পেছনের দিকে টানবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অপরিণামদর্শী পরিকল্পনার কারণে ২০২১-২২ সালে পিডিবির ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হতে পারে এবং এর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎতের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

হাসান মেহেদী জোর দিয়ে বলেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকার পরও নতুন করে জীবাশ্মভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি নেই। আরও বেশি রেকর্ড পরিমাণ লোকসান গুনতে না চাইলে এসব লোকসানি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনই বন্ধ করে দেয়া উচিত।

ইসমাইল আলী বলেন, সম্প্র্রতি পাঁচটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি দ্বিতীয় দফা নবায়ন করা হয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা বিদ্যুৎ খাতে বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাই মেয়াদ উত্তীর্ণ রেন্টাল কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন বন্ধ করা উচিত। তবে একান্ত প্রয়োজনে নবায়ন করা হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান বন্ধ করতে হবে।

প্রতিবেদনটির সুপারিশ অংশে বলা হয়েছে, অব্যবহƒত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া, ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে’ নীতি গ্রহণ করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করাই নতুন অর্থবছরের জন্য উপযুক্ত সিদ্ধান্ত। এর ফলে বিদ্যুৎ ব্যবহার ও সরবরাহের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য আসবে এবং বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আরও বেশি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা সম্ভব হবে, যাতে করে বিদ্যুৎ খাতের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর ক্রমবর্ধমান বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০